Skip to content

আজ সোমবার উল্টোরথ, মাসির বাড়ি থেকে মন্দিরের পথে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা!

নিজস্ব প্রতিবেদন : আষাঢ় মাসের দ্বিতীয়ায় শুক্লপক্ষে রথযাত্রায় বেরিয়ে পড়েন প্রভু জগন্নাথ। দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রাকে নিয়ে তাঁর এই স্বর্গীয় রথযাত্রা হিন্দু শাস্ত্রীয় বিধি মেনে ধুমধাম সহকারে আয়োজিত হয়। পুরীতে এই রথযাত্রার মহাসমারোহ তো দেখার মতো। কিন্তু, এই জগন্নাথ প্রভুর রথযাত্রা ও তাঁর বাড়ি ফেরার এই উল্টোরথ ঘিরে জমাট বেঁধেছে বেশ কিছু অনন্য কাহিনি। এই কাহিনিগুলো রথযাত্রা, উল্টোরথের মাহাত্ম্য প্রচার করে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বহু জগন্নাথদেবের মন্দির থাকলেও ঐতিহাসিক দিক থেকে এবং পৌরাণিক মান্যতার দিক থেকে সবচেয়ে প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্দির হল পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির। এই মন্দিরের রত্নসিংহাসনে একত্রে জগন্নাথদেব , বলভদ্র এবং সুভদ্রা বিরাজমান। কলকাতা থেকে বা হাওড়া থেকে ট্রেনে করে পুরী স্টেশনে পৌঁছানো যায়। পুরী স্টেশন থেকে টোটো বা গাড়ি ভাড়া করে জগন্নাথদেবের মন্দিরে পৌঁছানো যায়। তাছাড়াও উড়িষ্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর ভুবনেশ্বর থেকে মাত্র ৬০ কিমি দূরে পুরী অবস্থিত। তাছাড়াও কলকাতা নেতাজী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড়োজাহাজে করে ভুবনেশ্বরের বিজু পট্টনায়েক বিমানবন্দরে নেমে গাড়ি ভাড়া করে পুরীতে পৌঁছানো যায়। পুরীকে শ্রীক্ষেত্র বলা হয়ে থাকে এবং পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরকে শ্রীমন্দির বলা হয়। কারণ শ্রী অর্থাৎ লক্ষ্মী এই মন্দিরে এবং এইস্থানে অবস্থান করেন। তাই এই মন্দিরকে শ্রীমন্দির বলা হয়। তাছাড়াও পুরীকে নীলাচল, উড্ডয়ন পীঠ বলা হয়। উড়িষ্যা শিল্পরীতিতে এই মন্দিরটি নির্মিত । মন্দিরের রত্নবেদী থেকে মন্দিরের চূড়ার উচ্চতা হল ২১৪ ফুট। স্কন্দপুরাণ মতে শ্রীক্ষেত্রের আয়তন হল ১০ যোজন বা ৮০ মাইল। বর্তমানে পুরী 2 কিলোমিটার চওড়া এবং 4 কিলোমিটার লম্বা । উৎকল শিল্পরীতিতে মন্দিরটি চারটি ভাগে অবস্থিত। প্রথমটি হল গর্ভগৃহ বা বিমান বা দেউল যেখানে জগন্নাথদেব বলভদ্র এবং সুভদ্রা বিরাজ করছেন। তারপর হল মুখ্যশালা। তারপর হল জগমোহন বা নাট মন্দির যেখান থেকে হাজার হাজার ভক্ত জগন্নাথদেবকে দর্শন করেন। পূর্বে এই জগমোহন বা নাটমণ্ডপে দেবদাসীরা জগন্নাথদেবের উদ্দেশ্যে নৃত্যগীত পরিবেশন করতেন। চতুর্থ হল ভোগঘর যেখানে জগন্নাথদেবের ৫৬ প্রকারের ভোগ রন্ধন করা হয়।

মন্দিরের চূড়ায় নীলচক্র আছে। এই অষ্টধাতু নির্মিত নীলচক্র পুরীর যেকোন প্রান্ত থেকে দৃশ্যমান। যবন হরিদাস প্রতিদিন এই নীলচক্রকে দর্শন করে জগন্নাথদেবের উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করতেন। নীলচক্র দর্শন জগন্নাথদেবকে দর্শনের সমান বলে মানা হয়। নীলচক্র মন্দিরকে বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা করে। প্রতিদিন উঁচুতে উঠে ধ্বজা যা নীলচক্রের উপর লাগানো হয় তা পরিবর্তন করা হয়। প্রতি একাদশী তিথিতে নীলচক্রের স্থানে দ্বীপ জ্বালানো হয় এবং আশ্চর্যজনকভাবে এই দ্বীপ সমুদ্রের তীরের হাওয়াতে কখনই নেভে না। এই মন্দিরের উপর দিয়ে কোনো পক্ষী বা বিমান উড়ে যায় না। এই মন্দিরে বায়ু বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়। মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন অবন্তী নগরের রাজা ইন্দ্রদুম্ন। বর্তমানে যে মন্দিরটি দৃশ্যমান সেটি নির্মাণ করেছিলেন দ্বাদশ শতকের রাজা অনন্তদেব চৌড়গঙ্গ। মূল মন্দিরের সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশের সময় দেখতে পাওয়া যায় পতিত পাবন জগন্নাথদেবের মূর্তি। শোনা যায় একবার উৎকল রাজা রামচন্দ্র কোনো এক কারণে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে ছিলেন। তাই যেহেতু শ্রীমন্দিরে বিধর্মীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ তাই রাজা সিংহদ্বারের নিকটে এই পতিত পাবনকে প্রতিষ্ঠিত করেন যাতে তিনি প্রতিদিন জগন্নাথদেবের দর্শন পান। বিধর্মীরা এইস্থানে দাঁড়িয়ে পতিত পাবনকে দর্শন করেন। মন্দিরে পৌঁছানোর ২২ টি সিঁড়ি আছে। প্রবেশপথের ডানদিকে আছে আনন্দবাজার এবং বামদিকে আছে জগন্নাথদেবের রন্ধনশালা। এই রন্ধনশালায় আছে ৭৫২ টি উনুন। জগন্নাথদেবের মন্দিরের রন্ধনশালা খুবই অদ্ভূত। একটির পর একটি করে নটি মৃৎপাত্ত উনুনের পর স্থাপন করা হয় এবং সবচেয়ে উপরে থাকা মৃৎপাত্তের রান্না সবার অগ্রে হয়। একবার ব্যবহৃত পাত্র দুইবার ব্যবহার করা হয় না। তাই কথিত আছে নিকটবর্তী কুমোর পাড়ার কুমোররা জগন্নাথের জন্য মৃৎপাত্র বানানোর কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে তারা জগন্নাথদেবকে দর্শন করতে পারেন না। রন্ধনশালার মধ্য দিয়ে গঙ্গা নদী প্রবাহিত হচ্ছে যা বাইরে থেকে অদৃশ্যমান। মন্দিরের রান্না ওই জলেই হয়ে থাকে। ৫০০ জন রাঁধুনী এই রন্ধনশালায় রান্না করেন। স্বয়ং মা লক্ষ্মী এই সেবকদের দিয়ে রান্না করান। ব্রাহ্মণ শুদ্র নির্বিশেষে সকলে মন্দিরে ভোগ গ্রহন করতে পারেন। উৎসবের সময় লাখ লাখ ভক্ত এবং অন্যান্য সময়ে ২৫০০০ এবং তারও বেশি ভক্ত এই শ্রীমন্দিরে জগন্নাথদেবের প্রসাদ পান। কোনোদিন কোনো ভক্ত অভুক্ত থাকেন না। আশ্চর্যজনকভাবে জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ কখনও নষ্ট হয় না। আনন্দবাজার মন্দিরে প্রবেশের ডানদিকে অবস্থিত। এইখানে জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ পাওয়া যায়। জগন্নাথদেবকে নিবেদিত সমস্ত ভোগ প্রসাদ পুনরায় বিমলাদেবীকে নিবেদন করা হয়। তবেই তা মহাপ্রসাদে পরিণত হয়। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে, বিমলাদেবী হলেন এই পুরীধামে অবস্থিত একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম শক্তিপীঠের অধিষ্ঠাত্রী শক্তি বা দেবী। জগন্নাথদেবকে অনেক প্রাচীন গ্রন্থে দেবীর ভৈরব বলা হয়েছে। বহু শাক্ত এবং শৈব জগন্নাথদেবকে শিব বলে মানেন। জগন্নাথদেব হলেন একাধারে বিষ্ণু এবং শিব। মন্দিরকে ঘিরে আছে সুউচ্চ মেঘনাথ প্রাচীর। প্রাচীরটির উচ্চতা গড়ে ২২ ফুট। শ্রীমন্দিরকে শত্রুসেনাদের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য এই প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল। মন্দিরে মূল চারটি প্রবেশপথ এবং দ্বার আছে। পূর্বদ্বারের নাম হল সিংহদ্বার, পশ্চিমের দ্বারের নাম হল ব্যাঘ্র দ্বার, উত্তরের দ্বারের নাম অশ্বদ্বার এবং দক্ষিণের দ্বারের নাম হস্তীদ্বার। সিংহদ্বার হল ধর্মের প্রতীক, ব্যাঘ্র দ্বার হল বৈরাগ্যের প্রতীক, অশ্বদ্বার হল ত্যাগের প্রতীক এবং হস্তীদ্বার পার্থিব ঐশ্বর্যের প্রতীক স্বরুপ। ছোট বড়ো ত্রিশটি মন্দির মূল মন্দিরকে ঘিরে অবস্থান করছে। এর মধ্যে আছে মহালক্ষ্মীর মন্দির, নৃসিংহদেবের মন্দির, রোহিণী কুণ্ডের নিকটে বিমলা দেবীর মন্দির, হনুমান মন্দির এবং মহাপ্রভুর মন্দির ও অন্যান্য দেবদেবীর মন্দির। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকে ঘিরে এক পৌরাণিক কাহিনী আছে । একবার নীলমাধব রাজা ইন্দ্রদুম্নকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে বলেন যে তিনি এই পৃথিবীতে অবস্থান করছেন। তখন রাজা ইন্দ্রদুম্ন তার সকল ব্রাহ্মনদের পাঠিয়ে দিলেন নীলমাধবকে খুঁজে আনতে। সকল ব্রাহ্মন ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসলেও বিদ্যাপতি তখনও ফিরে আসেন নি। বিদ্যাপতি পথের পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে সবরদের গ্রামে এসে উপস্থিত হলেন। তখন সন্ধ্যাকাল, সবররাজ বিশ্ববসুর কন্যা ললিতা তুলসী তলায় সন্ধ্যা দিচ্ছিলেন। অচেনা বিদ্যাপতিকে দেখে ললিতা কিছুটা অবাক হয়ে যান। ললিতা বিদ্যাপতির পরিচয় জানতে চাইলেন। বিদ্যাপতি বললেন যে তিনি হলেন একজন ব্রাহ্মণ। বিশ্ববসু ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতিকে তার গৃহে আশ্রয় দিলেন। বিশ্ববসুর কন্যা পরমাসুন্দরী ললিতা বিদ্যাপতির সেবা করতে শুরু করলেন। ফলে ললিতা বিদ্যাপতির প্রেমে পড়ে গেলেন। বিদ্যাপতিও ললিতাকে ভালোবেসে ফেললেন। দুইজনের মনে ধীরে ধীরে প্রেমের বীজ অঙ্কুরিত হল। বিশ্ববসু তাদের প্রেমের কথা জানতে পেরে খুব খুশি হলেন।পাছে একমাত্র কন্যা তাকে ছেড়ে চলে যায় তাই বিশ্ববসু শর্ত রাখলেন যে ললিতাকে বিবাহ করে বিদ্যাপতিকে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে হবে। যদিও শ্বশুরবাড়িতে থাকা একজন পুরুষের পক্ষে খুবই অপমানজনক , তবুও বিদ্যাপতি রাজি হলেন। একটি শুভদিনে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হল। বিদ্যাপতি একটি বিষয় লক্ষ করছিলেন যে তার শ্বশুর বিদ্যাপতি প্রতিদিন মাঝরাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান এবং বিশ্ববসু যখন ফিরে আসেন তখন তার শরীর থেকে চন্দন, কপূর এবং কস্তুরীর এক অপূর্ব দিব্য সুভাষ নির্গত হয়। বিদ্যাপতি এটাও লক্ষ করলেন যে ললিতা প্রতিদিন রাত্রে একবার করে ঘর থেকে বেরিয়ে তার পিতাকে একটি জিনিস দেন এবং তারপর বিশ্ববসু গৃহ থেকে বেরিয়ে যান। বিদ্যাপতির মনে হয় যে ললিতা এবং তার পিতা কিছু একটা তার থেকে গোপন করতে চাইছেন। বিদ্যাপতি ললিতাকে নানাভাবে প্রশ্ন করেন। ললিতা বিদ্যাপতিকে জানান যে তার পিতা প্রতিদিন নীলগিরি পর্বতে নীলমাধবের পূজা করতে যান। বিদ্যাপতি নীলমাধবের কাছে যেতে চাইলেন। বিশ্ববসু শর্ত রাখলেন যে বিদ্যাপতি যেতে পারেন তবে বিদ্যাপতিকে চোখে কাপড় বেঁধে যেতে হবে। ললিতা পথের বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিদ্যাপতিকে একটি সরষের থলি দেন। বিদ্যাপতি ভাবলেন এটাই সুবর্ণ সুযোগ। যে পথ দিয়ে বিশ্ববসু তাকে নিয়ে গেলেন সেই পথে বিদ্যাপতি সরষে ছড়াতে ছড়াতে গেলেন। বিদ্যাপতি নীলমাধবকে দর্শন করলেন। অন্যদিকে বিশ্ববসু বিদ্যাপতিকে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে বলে পূজার সামগ্রী তৈরী করতে গেলেন। সেই সুযোগে বিদ্যাপতি রাজা ইন্দ্রদুম্নের কাছে গেলেন এবং সমস্ত কথা খুলে বললেন। রাজা সসৈন্যে নীলমাধব দর্শনে চললেন। পথপ্রদর্শক হলেন বিদ্যাপতি। তিনি সরষের দ্বারা চিহ্নিত করা পথ দিয়ে রাজাকে নিয়ে চললেন। কিন্তু কোথায় সেই নীলমাধব? রাজা ইন্দ্রদুম্ন নীলমাধবের দর্শন পেলেন না। বিশ্ববসু নীলমাধবকে সরিয়ে নিয়ে গেছেন ভেবে বিশ্ববসুকে বন্দি করলেন। রাজা আমরণ উপবাস করে নীলমাধবের তপস্যা করতে শুরু করলেন। নীলমাধব তাকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে বললেন যে রাজা ইন্দ্রদুম্ন যেন উৎকলে ফিরে যান। নীলমাধব সেখানে জগন্নাথদেব রুপে সকলকে কৃপা করবেন। রাজা ইন্দ্রদুম্ন বিশ্ববসুকে মুক্ত করে দিলেন। তিনি উৎকলে ফিরে গেলেন।


রাজা ইন্দ্রদুম্ন নীলমাধবের উদ্দেশ্যে এক বিশাল মন্দির নির্মাণ করলেন। কিন্তু মূর্তি কোথায় ? একদিন নীলমাধব রাজা ইন্দ্রদুম্নকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে বললেন যে একটি দারুকাষ্ঠ ভাসতে ভাসতে সমুদ্রের তীরে এসেছে। রাজা যেন অবিলম্বে সেই দারুকাষ্ঠ থেকে জগন্নাথদেব, বলভদ্র এবং সুভদ্রার তিনটি মূর্তি নির্মাণ করিয়ে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা লোকলস্কর নিয়ে দারুকাষ্ঠ উদ্ধার করতে যান। কিন্তু শত চেষ্টাতেও সৈন্যরা সেই দারুকাষ্ঠ নিয়ে আসতে পারল না। বিশ্ববসু এবং বিদ্যাপতি দুইজনে মিলে দারুকাষ্ঠ তুলে নিয়ে আসলেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল মূর্তি বানানোকে কেন্দ্র করে। যেসব কারিগররা মূর্তি বানাতে এসেছিলেন, তারা ছেনি দিয়ে কাষ্ঠে আঘাত করতেই ছেনি ভেঙে গেল। তাই রাজা ইন্দ্রদুম্ন খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ভগবানের নির্দেশে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা কারিগরের ছদ্মবেশে রাজার নিকটে এলেন। এই শিল্পীর নাম ছিল অনন্ত বাসুদেব মহারাণা। রাজা তাকে মূর্তি নির্মাণের কাজ দিলেন। বিশ্বকর্মা রাজাকে বললেন যে তিনি বদ্ধঘরে ২১ দিন ধরে মূর্তি নির্মাণ করবেন। কেউ যেন এই সময় বদ্ধ ঘরের দরজা না খোলে। কেউ যদি দরজা খোলে তবে তিনি তার কাজ অসম্পূর্ণ রেখে চলে যাবেন। প্রথম দশদিন ছেনির শব্দ শোনা গেলেও একাদশ দিন থেকে ছেনির শব্দ শোনা গেল না। সবাই ভাবল কারিগর বোধ হয় অনাহারে মারা গেছেন। রানী গুণ্ডিচার নির্দেশে ১৪ তম দিনে দ্বার খোলা হল। রাজা ইন্দ্রদুম্ন দেখলেন অসম্পূর্ণ তিনটি বিগ্রহ। রাজা ইন্দ্রদুম্ন খুব দুঃখিত হলেন। তখন নারদ তাকে সান্তনা দিলেন এবং এই বিগ্রহই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করতে বললেন। ইন্দ্রদুম্ন মন্দিরে জগন্নাথদেবকে প্রতিষ্ঠা করলেন। অবন্তীর রাজা ইন্দ্রদুম্ন যখন ব্রহ্মাকে মন্দির উদ্বোধনের জন্য আমন্ত্রণ করতে গিয়েছিলেন তখন ব্রহ্মা হোম করছিলেন। ইন্দ্রদুম্নকে ব্রহ্মা দুই মিনিট অপেক্ষা করতে বললেন। দুই মিনিট পর ব্রহ্মা ইন্দ্রদুম্ন সাথে সাক্ষাৎ করতে এলেন। তখন ইন্দ্রদুম্ন তার মন্দির প্রতিষ্ঠার সম্বন্ধে ব্রহ্মাকে জানালেন। ব্রহ্মা ইন্দ্রদুম্নকে বললেন যে—“ তুমি যে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলে তা বর্তমানে আর নেই। কারণ ব্রহ্মলোকে ২ মিনিট সময়ের মধ্যে দুইবার প্রলয় হয়ে গেছে। তাই তুমি আগে তোমার মন্দির খুঁজে বের করো। ” ইন্দ্রদুম্ন তাই মন্দির খোঁজার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও তিনি মন্দির খুঁজে পেলেন না। শেষে নীলমাধবকে শরণ করলেন। নীলমাধব তাকে বললেন যে—“ তোমার মন্দির উৎকলরাজ কালমাধব ঘোড়ায় চড়ে যাওয়ার সময় বালির তলদেশ থেকে খুঁজে পেয়েছিল। এখন সে তোমার মন্দিরটিকে নিজের মন্দির ভেবে সেই মন্দিরে রাধাকৃষ্ণকে প্রতিষ্ঠা করে পূজা অর্চনা করছে। তুমি যাও। তুমি গিয়ে কালমাধবকে সব কিছু খুলে বলো। ” ইন্দ্রদুম্ন তাই করলেন। কিন্তু কালমাধব বিশ্বাস করলেন না। ইন্দ্রদুম্ন গোপালকে সাক্ষী রেখে এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। তাই তখন ইন্দ্রদুম্ন গোপালের শরণ নিলেন। গোপাল রাজা কালমাধবকে স্বপ্নাদেশ দিলেন এবং কালমাধবকে জানালেন যে এই মন্দির রাজা ইন্দ্রদুম্ন নির্মাণ করেছেন। কালমাধব ইন্দ্রদুম্নকে তার প্রতিষ্ঠিত মন্দির ফিরিয়ে দিলেন। তারপর নারদের পরামর্শ মতো ব্রহ্মাকে ইন্দ্রদুম্ন আমন্ত্রণ করছিলেন। স্বয়ং ব্রহ্মা এই মন্দিরের দ্বার উদঘাটন করেছিলেন।


মন্দিরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হল নবকলেবর। এইসময় জগন্নাথদেব , বলভদ্র, সুভদ্রা এবং সুদর্শনের মূর্তি পরিবর্তন হয়। তারা নবনির্মিত মূর্তিতে বিরাজ করতে শুরু করেন। যে বছর আষাঢ় মাস মলমাস হয় সেই বছর জগন্নাথদেব , বলভদ্র এবং সুভদ্রার নবকলেবর হয়। নীলগিরি পর্বতে যে নিম বৃক্ষ থেকে চন্দনের সুভাষ নির্গত হয় সেই বৃক্ষের কাষ্ঠ থেকে জগন্নাথদেব, বলভদ্র এবং সুভদ্রার মূর্তি নির্মাণ করা হয়। যেইদিন নতুন জগন্নাথদেব, বলভদ্র এবং সুভদ্রার মূর্তি শ্রীমন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়, সেইদিন ব্রহ্ম পরিবর্তন করা হয়। একজন সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ ব্রাহ্মণ এই ব্রহ্ম পরিবর্তনের কাজ করেন। যেইদিন এই কাজ করা হয়, সেইদিন সমস্ত পুরীতে বিদ্যুৎ পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। নবকলেবর বিগত ২০১৫ সালে হয়েছিল। এই নবকলেবরটি হয়েছিল ১৯ বছর পর। যে ব্রাহ্মন এই নবকলেবরের সময় ব্রহ্ম পুনঃস্থাপন করেন, তিনি একবছরের মধ্যে দেহত্যাগ করেন। কথিত আছে সেই ব্রাহ্মণ মৃত্যুর পর বৈকুণ্ঠলোক প্রাপ্ত করেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য এই পুরীধামে দীর্ঘ আঠারো বছর অবস্থান করেছিলেন। তিনি প্রতিদিন গরুড় স্তম্ভের কাছে দাঁড়িয়ে জগন্নাথদেবকে দর্শন করতেন। অনেকে চৈতন্যদেবকে সচল জগন্নাথ বলে থাকেন। শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরুনানক জগন্নাথদেবের মন্দিরে এসেছিলেন। সেইসময় জগন্নাথদেবের মন্দিরে চৈতন্যদেবের সঙ্গে গুরুনানকের সাক্ষাৎ হয়েছিল। অনেক গ্রন্থে বলা হয়েছে যে চৈতন্যদেব জগন্নাথদেবের মন্দিরে অদৃশ্য হয়ে যান। এটা ধরা হয় যে চৈতন্যদেব জগন্নাথের মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়ে ছিলেন। যদিও চৈতন্যদেবের অপ্রকট হওয়া নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। তবে এটা সত্য যে নীলাচলেই মহাপ্রভু অপ্রকট হয়েছিলেন। আঠারো বার আক্রমণের শিকার হয়েছে এই শ্রীমন্দির। বিধর্মীরা বার বার জগন্নাথদেবের আলয় ধ্বংস করেছেন। তারপর জগন্নাথদেবের কৃপায় পুনরায় শ্রীমন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে শ্রীমন্দিরে বিধর্মীদের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

এরপর দশমী তিথিতে ৯ দিনের মাথায় গুন্ডিচা মন্দির থেকে বাড়ি ফেরেন। নন্দীঘোষ রথে চড়েন জগন্নাথ, বলরাম চড়েন তালধ্বজে, সুভদ্রা দর্পদলন রথে চড়ে এই যাত্রা সম্পন্ন করেন। উল্টো পথে রথ আসায় এই যাত্রা উল্টোরথ নামে পরিচিত। বহুড়া যাত্রাও বলা হয়।

Latest