আজকে কথা বলবো এমন একটি ব্যাক্তি যার নামের আগে কখনও শ্রী লাগেনি, খান তিনেক জামা, একটি ছেঁড়া রাবার চপ্পল,একটা অ-খিলানযুক্ত চশমা এবং ৭৩২ টাকার জমা মূলধনের মালিক। ইনি হলেন পশ্চিম ওড়িশার বাসিন্দা কবি পদ্মশ্রী হলধর নাগ। পরণে সাদা ধুতি আর সাদা কুর্তা। খালি পা, পিঠে গড়িয়ে পড়েছে কোকড়ানো, তেলতেলে লম্বা চুল। সম্বলপুরের রাস্তায় চানা-ঘুগনি বিক্রেতা এই ব্যক্তিকে অনেকেরই চোখে পড়ে না। বা অনেকে দেখেও চোখ ঘুরিয়ে চলে যান হয়তো!তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করা মানুষের ওপর সমাজের শিক্ষিত মানুষেরা PHD করছেন। যিনি কোসলি ভাষার বিখ্যাত কবি। বিশেষ কথা হল, তিনি এ পর্যন্ত যতগুলো কবিতা ও ২০টি মহাকাব্য রচনা করেছেন, তার সবগুলোই তার জিহ্বার ডগায় । এবার তাঁর লেখা 'হলধর গ্রন্থাবলী-২'-এর একটি সংকলন সম্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেবাসের অংশ করা হবে। তবে তাঁকে যতটাই হীন মনে করুন না কেন, পোশাক বা বাহ্যিক রূপ দিয়ে কিন্তু এই মানুষটিকে বিচার করা সম্ভব নয়। অত্যন্ত সাদামাটা ভাবে জীবন কাটানো এই মানুষটির মধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে এক গভীর প্রতিভা।
সাদা পোশাক, সাদা ধুতি, গামছা ও গেঞ্জি পরিহিত হলধর নাগ খালি পায়েই থাকে্ন। উড়িশ্যার লোক-কবি হলধর নাগ একটি দরিদ্র পরিবারের মানুষ। ওড়িষার সম্বলপুর থেকে ৭৬ কিলোমিটার দূরে বরগড় জেলা। এই জেলাতেই ১৯৫০ সালে অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্ম তাঁর। মাত্র ১০ বছর বয়সে বাবাকে হারান। বাবাই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। ১০ বছর বয়সে বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর তৃতীয় শ্রেণিতেই পড়া ছেড়ে দেন তিনি। অনাথ জীবনে, তিনি বহু বছর ধরে ধাবায় বাসনপত্র পরিষ্কার করে কাটিয়েছেন। পদ্মশ্রী সম্মানও দেওয়া হয়েছে তাঁকে। অবাক লাগছে তো? তাঁর জীবন সংগ্রাম যত জানবেন, ততই আরও অবাক হয়ে উঠবেন।পরে একটি স্কুলে রান্নাঘর দেখাশোনার কাজ পান তিনি। কয়েক বছর পরে ব্যাঙ্ক থেকে ১০০০ টাকা ঋণ নিয়ে পেন-পেনসিল ইত্যাদির একটি ছোট দোকান খোলেন সেই স্কুলের সামনেই ।
এটাই ছিল তার আর্থিক অবস্থা। এবার আসা যাক তাঁর সাহিত্যের বিশেষত্বে। ১৯৯৫ সালের দিকে হলধর স্থানীয় ওড়িয়া ভাষায় "রাম-শবরী" র মতো কিছু ধর্মীয় পর্বের উপর লেখালেখি শুরু করেন এবং মানুষকে সেগুলো আবৃত্তি করে শোনাতে শুরু করেন।
আবেগে ভরপুর কবিতা লিখে মানুষের মধ্যে জোর করে উপস্থাপন করে তিনি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে, ২ বছর আগে রাষ্ট্রপতি তাকে সাহিত্যের জন্য পদ্মশ্রী দেন।
শুধু তাই নয়, ৫ জন গবেষক এখন তার সাহিত্যে পিএইচডি করছেন যেখানে হলধর নিজেই তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তাঁর সবকটি কবিতাই প্রশংসিত হয়। এর পর তিনি আরও কবিতা লিখতে শুরু করেন। ধর্ম, প্রকৃতি, সমাজ- এ রকম বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি লিখতে শুরু করেন। ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন তিনি। ২০১৯ সালে তিনি সম্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রিও অর্জন করেন। দেশ প্রেমিক হতে গেলে শিক্ষার দিক দিয়ে কিংবা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বলশালী হওয়ার দরকার নেই, চাই শুধুমাত্র দেশ ভক্তি দেশের মানুষের সেবার ইচ্ছা।