ঢাকা, জাকির হোসেন: ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে ‘অপহরণ করে হত্যার ষড়যন্ত্রের’ মামলায় হাসিনা সরকারের আমলে বন্ধ হওয়া যাওয়া বাংলাদেশের তুমুল পাঠকপ্রিয় ও প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকা আমার দেশ এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) শুনানি শেষে এই আদেশ দেন ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মাহাবুবুল হক। এইদিন মাহমুদুর রহমান আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। শুনানিতে তাঁর আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, 'এই মামলা কার জন্য, কখন করা হয়েছে-এটা আমরা না-ই বললাম। এই মামলাটির ঘটনা ঘটেছে আমেরিকায়। সেখানকার আইনব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী, সেটা আমরা জানি। কারসাজি করে মামলার ঘটনাটি বাংলাদেশে দেখিয়ে একটি সাজানো মামলা দেওয়া হয়েছে। সেই মামলায় আপসহীন সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ১২৩ ধারায় তাকে আরো দুই বছরের সাজা দেয়া হয়েছে, যেটা সহযোগী হিসেবে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এ মামলায় সাংবাদিক শফিক রেহমান সহ আরও দু'জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।' তিনি বলেন, 'মাহমুদুর রহমান আইনের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। তিনি বিদেশে ছিলেন, আইন মান্য করে আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। তিনি আইনের প্রতি এতই শ্রদ্ধাশীল- তিনি যখন কারাগার থেকে আদালতে আসতেন, তিনি বিশেষ সুবিধায় গাড়ি না নিয়ে সাধারণ প্রিজন ভ্যানে করেই আদালতে আসতেন। আমরা বিনীত আবেদন করব, আমরা আপিল করার জন্য প্রয়োজনীয় সই মুহুরির নকল যেন দ্রুত পেতে পারি- তার জন্য বিজ্ঞ আদালত দয়া করে একটি আদেশ দেবেন। এছাড়া কারাবিধি অনুসারে তিনি যেসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকারী, আমি আবেদন করব তাকে যেন সে সুবিধাগুলো দেওয়া হয়।' তিনি মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে প্রথম শ্রেণির ডিভিশন দেওয়ার নির্দেশনা চাইলে বিচারক কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। মাহমুদুর রহমানের নিয়োজিত আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, 'মোট সাজার পরিমাণ ৭ বছর হওয়ায় এই আদালত আপিলের শর্তে জামিন দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন না বিধায় আমরা জামিনের আবেদন করিনি। আমরা শুধুমাত্র আত্মসমর্পণ ও ডিভিশনের আবেদন করেছি। ডিভিশনের বিষয়ে কারাবিধি অনুসারে ব্যবস্থা নেয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত।' শুনানি শুরুর আগে এজলাস কক্ষ থেকে বের হয়ে গণমাধ্যমের সামনে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, 'আমি কোনো দলের হয়ে কখনও লড়াই করিনি। আমি অতীতে যেমন ন্যায়ের জন্য লড়াই করে গেছি, এই ন্যায়ের লড়াই অব্যাহত থাকবে। আমি ন্যায়ের জন্য লড়াই করে যাব।' এই মামলায় গত বছরের ১৭ আগস্ট মাহমুদুর রহমান, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট শফিক রেহমান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)'র সাংস্কৃতিক সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) সহ সভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহ মামুন, তার ছেলে রিজভী আহাম্মেদ এবং আমেরিকাপ্রবাসী ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান ভূঁইয়াকে ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় আদালত৷ মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের আগে যেকোনো সময় থেকে এই পর্যন্ত বিএনপির সাংস্কৃতিক সংগঠন জাসাসের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহ মামুন সহ বিএনপি ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটভুক্ত অন্যান্য দলের উচ্চপর্যায়ের নেতারা ঢাকার পল্টনের জাসাস কার্যালয়ে, আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার আসামিরা একত্রিত হয়ে যোগসাজশে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তার প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে আমেরিকায় অপহরণ করে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। ওই ঘটনায় তৎকালীন ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ফজলুর রহমান ২০১৫ সালের ৩ আগস্ট পল্টন মডেল থানায় মামলাটি করেন। ২০১৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এই পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এই মামলায় সজীব ওয়াজেদ জয় সহ ১২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়৷ বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রাক্তন উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান রাষ্ট্রদ্রোহের এক মামলায় ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল ঢাকার কারওয়ান বাজারে আমার দেশ পত্রিকার অফিস থেকে গ্রেপ্তার হন। পরে কারাবান্দি অবস্থায় ২০১৬ সালের এপ্রিলে তাঁকে জয়কে অপহরণ ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সাড়ে তিন বছর জেলে থাকার পর ২০১৬ সালের নভেম্বরে মাহমুদুর রহমান জামিনে মুক্তি পান। পরে তিনি লন্ডনে চলে যান। সাড়ে ৫ বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে গত শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) তিনি দেশে ফেরেন। আরেক সাংবাদিক শফিক রেহমানকে ২০১৬ সালের এপ্রিলে ঢাকার ইস্কাটনের বাসা থেকে গ্রেপ্তারের পর জয়কে অপহরণ ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সেসময় দু'দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এই সাংবাদিককে। পাঁচ মাস কারাগারে থাকার পর সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে জামিনে মুক্তি পান দৈনিক যায়যায়দিনের এই প্রাক্তন সম্পাদক। পরে তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ১৮ আগস্ট তিনি দেশে ফেরেন। প্রসঙ্গত, মাহমুদুর রহমান ও শফিক রেহমান বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয় দুই সাংবাদিক৷ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাঁরা সবসময় সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন৷ স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের সমালোচনা করে এই দুই সাংবাদিক ওই সরকারের বিরাগভাজন হয়েছিলেন৷ ধারণা করা হয়, তারই রেশ ধরে একের পর এক মিথ্যা মামলা ও সাজা দিয়ে এই দুই সাংবাদিককে হয়রানি করার চেষ্টা করেছিল হাসিনা সরকার৷ এমনকি ২০১৮ সালের জুলাইতে কুষ্টিয়ায় একটি মানহানি মামলায় জামিন নিতে গিয়ে হাসিনার আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ও বিশ্বে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন মাহমুদুর রহমান। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করে ছাত্রলীগ৷ ওই হামলায় তাঁর মাথা ও মুখ ব্যাপকভাবে জখম হয়। এ ছাড়া তাঁকে বহনকারী গাড়িটি ভেঙে দেয় হামলাকারীরা। পরে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে সেদিন আদালত চত্বর ছেড়ে যেতে সমর্থ হন মাহমুদুর রহমান৷ ওই হামলায় কুষ্টিয়ার তৎকালীন প্রশাসনও ছাত্রলীগকে সহায়তা করেছিল বলে অভিযোগ ওঠে৷ এই ঘটনার পরে মাহমুদুর রহমান প্রবাসে চলে যান৷ সেখানেই নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে গত শুক্রবার স্বদেশে ফিরলেন এই সাংবাদিক৷