অরণ্যে ঘেরা ঝাড়গ্রাম শহরের বুক চিরে রাজ্য সড়কের একদিক চলে গেছে বেলপাহাড়ী- পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার দিকে । অন্যদিক লোধাশুলিতে মিশেছে জাতীয় সড়ক ৬ অর্থাৎ কলকাতা- মুম্বাই সড়ক এর সঙ্গে । অরণ্য ধংসের বাধনহীন আনন্দে যখন পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সর্বত্র মাতোয়ারা তখন ঝাড়গ্রাম শহর ঘেসা বনাঞ্চল গভীর-ঘন-সবুজ চাদরে মোড়া । একটা মহকুমা শহরের পাশে দক্ষিনবঙ্গে এইরকম বনান্চল আছে কিনা আমার জানা নেই ।শুধু তাই নয় শহরের রাস্তার ধারে , পার্কে , ষ্টেডিয়ামে সর্বত্র একশ বছরের বেশী পুরোনো সুন্দর সব শাল গাছ জানান দেয় এ ভূমি আমাদের ।
২০০৮ সালের এপ্রিল মাস । সেই দিনটা সকাল থেকে নিরুপদ্রবে কেটেছে । নিশ্চিন্ত মনে অফিসের কাজ করেছি । রাত এগারোটা নাগাৎ রাতের খাবার খেয়ে টি.ভি.তে অনেকদিনের পুরোনো একটা সিনেমা তন্ময় হয়ে দেখছি এমন সময় মোবাইলটা একটা বিচ্ছিরি শব্দ করে বেজে উঠল । মোবাইলের স্ক্রীনে দেখলাম একটা অচেনা নম্বর । অচেনা নম্বর মানেই কোন খবর । আনেকেই তো রাতে ফোন ধরে না । আমাকে ফোন ধরতেই হবে এমন কোন নিদ্দেশ আছে ? সরকারি নির্দ্দেশ কি আছে জানি না, আমি আমার ফোন দিন-রাত খোলাই রাখি । চেষ্টা করি সব ফোন ধরতে । মাঝে-মাঝে বিরক্ত লাগে । তবু মনে হয় এই চাকরী পাবার জন্য কত বেকার যুবক চেষ্টা করে চলেছে । আমি তো ভাগ্যবান । তাছাড়া এমন অসময়ে যিনি ফোন করছেন তিনি বিপদে পড়েই ফোন করছেন ।
নিজের স্বভাবমতই অচেনা ফোন রিসিভ করে বললাম, হ্যালো ।
-হ্যালো । বড়বাবু বলছেন ?
-হ্যা , বলছি ।
- স্যার, ঝাড়গ্রামের সাবিত্রি সিনেমা হলের কাছে একটা জন্তু দেখা গেছে । এইমাত্র একটা দোকানে ঠুকেছে । একবার আসুন ।
এক ঝটকায় সিনেমার আনন্দ মাথায় , তাড়াতাড়ি বললাম , কেমন জন্তু ?
-স্যার, তিন- চার ফুট লম্বা মত হবে । মুখ ছুচালো, অনেকটা কচ্ছপের মত ।
-ঠিক দেখেছেন ?
- অন্ধকারে য়তটুকু দেখা যায় ।
- ঠিক আছে, একটু পাহারা দিয়ে রাখুন, যত জলদি সম্ভব আমরা আসছি ।
ফোন কেটে গেল । জন্তু বিবরন চিন্তা করে মাথায় জন্তুর ছবি আঁকতে শুরু করলাম। জন্তুটা কি ? কোথা থেকে আসতে পারে ? কি জন্তু এখানে আছে.............? নানান চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল ।
তিন- চার ফুট লম্বা, মুখ ছুচালো, অনেকটা কচ্ছপের মত .......? এ আবার কি জন্তু ? যে কোন জন্তু হোক আমাদের যেতেই হবে ।নিজেকে তৈরী করে অফিসের দিকে বেরিয়ে পড়লাম । নৈশ্য প্রহরীরা খাটিয়া,তোষক, মশারী টাঙ্গীয়ে ঘমুচ্ছে । এখন গভীর রাত ওদের , ওদের কাজ রাতে অফিস পাহারার কিন্তু ঘুমোচ্ছে । আমার কাজ ওদের ঘুম ভাঙ্গানো । কয়েকবার জোরে-জোরে ডাকার পর ওদের একজন মশারী তুলে আমাকে দেখল ।
আমি বললাম, এত জলদি শুয়ে পড়েছ ? অফিসের ফোন বেজে যাচ্ছে শুনতে পাচ্ছ না ? তোমাদের চাকরী থাকা উচিত নয় । দায়-দায়িত্ব-ভয় কিছুই নেই ? যাও কুন্তলবাবু, সুরেশ আর সুভাসকে খবর দাও অফিসে এখুনি আসতে । খবর আছে, বাইরে যেতে হবে । জলদি ।
কুন্তলবাবু বীট অফিসার, আমার কোয়াটারের পাশের কোয়াটারে থাকেন । সুরেশ, সুভাস সহ আরও চোদ্দ-পনের জন আমাদের বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্ম্মচারীরা এখানে থাকে । প্রায় সকলেই শুয়ে পড়েছে । আমাদের শুয়ে পড়লে ও প্রয়োজনে বিছানা ছেড়ে উঠে আসতে হবে । চব্বিশ ঘন্টার ডিউটি । তবে এটা সব কর্ম্মচারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় । কিছু কর্ম্মচারী আছে তারা এ সবের উর্দ্ধে ।
ঝাড়গ্রাম রেজ্ঞের অধীনেই ঝাড়গ্রাম মিনি চিড়িয়াখানা । রেজ্ঞ অফিস ধেকে তিন কিলোমিটার । এখানে কয়েকজন অভিজ্ঞ কর্মচারী আছে যারা সাপ,হনুমান,পাখী সহ নানান বন্যপ্রানী ধরতে অভ্যস্ত । এরা বন বিভাগের সম্পদ । এরা আছে বলেই অনেক কঠিন কাজ অতি সহজেই হয়ে য়ায় ।
মিনি চিড়িয়াখানার বীট বাবু গোপাল দাস । আজকের অভিযানে ওনার কর্মচারীদের সাহায্য চাই ।
গোপাল বাবুকে ফোন করলাম, হ্যালো ।
হ্যালো, গুড ইভিনিং স্যার ।
গুড ইভিনিং। একটা খবরের জন্য ফোন করলাম ।
হ্যা , স্যার বলুন । চুনারাম,লাল,মহিযা আর সাহেবকে একটা নাইলনের জাল,একটা খাঁচা আর বড় দুটো টর্চ, বস্তা আর ঝুড়ি দিয়ে সাবিত্রি সিনেমা হলের কাছে পাঠান । একটা বুনে জন্তু ধরতে হবে ।
গোপাল বাবু একটু থেমে বললেন , এত রাতে কিভাবে ওরা যাবে ?
বললাম, কারো মোটরসাইকেল নেই ?
উনি বললেন , একজনের আছে তবে অত জিনিস কিভাবে যাবে ?
বীটবাবুর কথায় খানিক চিন্তা করে বললাম , ঠিক আছে, রেজ্ঞের মটর সাইকেলটা পাঠাচ্ছি । ওদের জলদি আসতে বলুন ।
এত রাতে গাড়ীভাড়া সহজে পাওয়া যাবে না । ঝাড়গ্রামের গাড়ীর স্ট্যান্ডে বড় জোর রাত নয়টা অবধি দু-একটি গাড়ী থাকে । রাত নয়টার পর সব ফাঁকা । খুব প্রয়োজন না হলে রাতে ঝাড়গ্রাম থেকে কোনদিকে কেউ য়ায় না , সব দিকেই ছিনতাই এর ভয় ।পরিচিত কয়েকজনের গাড়ী আছে তবে তাদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে ডেকে ড্রাইভার এনে আসতে এক ঘন্টা তো লাগবেই । আমাদের হাতে অত সময় নেই । বেশী দেরী হলে যে কোন অঘটন ঘটতে পারে । তাছাড়া দিনে স্থানীয়-বাইরের মানুষ বেশী থাকে এমন খবরে তাদের সামলানের জন্য চাই লোকবল, গাড়ী, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি । কিন্তু এখন বেশ রাত । বাইরের লোকজনতো নেইই এমন কি স্থানীয় মানুষ ও বেশী নেই , গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন । অর্থা জনতার সমাগম আর উৎসাহ কম হওয়া স্বাভাবিক ।
সুরেশ চলে এসেছে । ওকে বলাম, তুমি মটর সাইকেলটা নিয়ে ঝাড়গ্রাম মিনি চিড়িয়াখানায় যাও ।
ও মিনি চিড়িয়াখানায় যেতে ইতঃস্তত করছিল । আমি বুঝতে পেরে বললাম, একা যেতে ভয় করছে ?
ঠিক আছে আমি আর কুন্তল বাবু তোমার সঙ্গে যাচ্ছি । আমরা অন্য একটি মটর সাইকেলে সুরেশকে কদম কাননের দিকের ঘন জঙ্গলের মাঝবরাবর এগিয়ে দিলাম।
ওর দোষ নেই । ঝাড়গ্রাম রেজ্ঞ থেকে মিনি চিড়িয়াখানা তিন কিলোমিটার পথের এক কিলেমিটার পথের দুপাশে শালের ঘন জঙ্গল,পুরোটাই ফাঁকা । এই রাস্তা সোজা চলে গেছে বাঁধগোড়ার দিকে । রাত আটটার পর এই রাস্তায় একাকি বা দু-তিন জন যাওয়া ভয়ের । কারন জঙ্গলের পাশে ছিনতাইকারীরা ওত পেতে থাকে । সুযোগ বুঝলে মুগুরের মত লাঠির আঘাত বসিয়ে পথচারীদের সর্বস্ব লুঠ করে নেয় ।
সুরেশকে মিনি চিড়িয়াখানার রাস্তায় ছেড়ে আমরা সোজা সাবিত্রি সিনেমা হলের দিকে রওনা হলাম । রাত প্রায় বারোটা । দোকান-পাট বন্ধ , যানবাহন নেই , সুন-সান রাস্তা । রাস্তার ধারে আলোগুলে যতটুকু আলেকিত করে রেখেছে ততটুকুই দেখা যাচ্ছে । অজানা উওেজনায় শরীর-মন চঞ্চল জয়ে রয়েছে। ঝাড়গ্রাম শহর জঙ্গল ঘেরা বলেই নানান প্রজাতির বন্য জন্তু এখানে আছে । এক সময় এ জঙ্গলে রাজারা-জমিদারেরা ঘটা করে শিকার করত । জঙ্গলের মাঝে – মাঝে আবার কিছু গ্রাম আছে , জোয়ালভাঙ্গা,বরিয়া, সুসনিগেরিয়া,টিয়াকাঠি, বালিয়া,গোবিন্দপুর,পিয়ালগেড়িয়া...........সহ নানান গ্রাম । এরা কোন সময় এসেছিল বেঁচে থাকার সন্ধানে । সেই এক সময়ের গ্রামগুলো আজ বেশ জমজমাট। বিদ্যুতের আলো,কেবল লাইন, ফোন ......সব আছে প্রায় শহরের মত । নেই শুধু আগের মত নানান প্রজাতির বন্য প্রানী , বন্য পরিবেশ ও বনজ সম্পদ ।
বন শেয হওয়া আর বনে মানুষের গতিবিধি বেড়ে য়াওয়ার ফলে বন্য জন্তুরা অসহায় হয়ে পড়েছে । মাঘ-ফাগুনে যখন বনে শাল গাছের শুকনো শাল পাতা ঝরে পড়ে তখন দূর থেকে বনের অনেক দূর দেখা য়ায় । এই সময় জঙ্গলবাসীদের কিছু মানুষ বন্য জন্তু শিকারে মেতে ওঠে । শাল গাছের শুকনো পাতায় এরা বা এদের কেউ আগুন লাগিয়ে দেয় । আগুনের ভয়ে বন্যজন্তুরা দিনে-রাতে নিজেদের বাঁচাতে প্রানভয়ে যেদিক-সেদিক ছুটতে থাকে । এর ফলে কিছু বুনো জন্তু শিকারীর হাতে মারা য়ায় আবার কিছু বুনো জন্তু আহত হয় বা আগুনে পুড়ে মারা য়ায় । বনের প্রচুর চারা গাছ নষ্ট হয় , বন্য প্রানীর খাদ্যের টান পড়ে , প্রচুর বনজ সম্পদ নষ্ট হয় । কত ক্ষতি যে হয় তাঁর হিসেব করলে আঁতকে উঠতে হবে । প্রতি বছরই এটা চলছে সারা ভারতবর্য় জুড়ে
এই সময় অনেক বন্য প্রানী বন ছেড়ে পথ ভুলে লোকালয়ে চলে আসে । আজ রাতে এরকমই কোন ঘটনার জন্য বন্যপ্রানীটি জঙ্গল ছেড়ে চলে এসেছে শহরে, লোকালয়ে । এই সব প্রানীদের বাঁচানো এবং আবার বনে ছেড়ে দেওয়া আমাদের কাজ । বন্য জন্তুরা বনে থাকে- এসব গল্পে,ছবিতে সুন্দর লাগে । কিন্তু লোকালয়ে ? লোকালয়ে এলে এরা উৎসাহী মানুষের উৎসাহে আর ভালবাসার ঠেলায় হয় বেঘোরে প্রান য়ায় না হয় আহত হয় ।নচেৎ তাঁর ঠাই হয় চিড়িয়াখানায় ।
ঝাড়গ্রাম রেজ্ঞ অফিস থেকে সাবিত্রি সিনেমা মন্দির বড় জোড় এক কিলোমিটার। এইটুকু পথ আসতে আমাদের প্রায় পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগল । আসলে খবর পাবার সবাইকে খবর দিয়ে তৈরী হতে সময় তো লাগবেই । ঝাড়গ্রাম মিনি জু থেকে ওরা এখনো এসে পৌঁছুইনি । ওদের তৈরী হতে সময় লাগবে । তাছাড়া নাইলনের জাল, খাঁচা , টর্চ, বস্তা , ঝুড়ি, দড়ি.........এসব গুছিয়ে আনতে হবে। সঙ্গে এই সব কাজে অভিজ্ঞ কর্মচারী দরকার , ওরা সব ঘুমোচ্ছিল । ঘুম থেকে উঠে তৈরী হতে সময় লাগবেই ।
আমাদের পোঁছুতে দেখে অত রাতেও কৌতুহলী মানুষের জটলা বেড়ে গেল । ভাগ্যিস রাত, সঙ্গে পুলিশ , নইলে কপালে দূর্ভোগ ছিল । আবার ফোন , তবে এটা সাংবাদিকের। ফোন ধরে বললাম , হ্যালো ।
হ্যালো , দাদা । খবরটা শুনেছ ?
কি খবর ? পুলিশ থেকে খবর পেলাম সাবিত্রি সিনেমা হলের কাছে অদ্ভূদ এক জন্তু দেখা গেছে ? এটা সত্যি ।বললাম, আমি সাবিত্রি সিনেমা হলের কাছেই আছি ।এখনও অপারেশন শুরু করিনি, ঝাড়গ্রাম মিনি জু থেকে ওরা এখনো এসে পৌঁছুইনি । ওরা এলেই কাজ শুরু করব । জানি না কি জন্তু আছে ? খবরটা সত্যি ।
অপারেশনটা হয়ে গেলে একটু ঘটনাটা বলবে । এত রাতে খবর য়াবে না । আগামীকাল খবরটা করব ।
ঠিক আছে ।
ঠিক আছে , গুড নাইট দাদা ।
গুড নাইট ।
চুনারাম, লাল, সুভাষ , সুরেশ এইমাত্র এল । ওদের আসতে দেখে আমি বুকে বল পেলাম । স্থানীয় উকজনকে জিজ্ঞেস করলাম , জন্তুটা কোথায় ?
আমার কথা কেড়ে নিয়ে একজন বলল, এই দোকানের ভেতর ।
জিজ্ঞেস করলাম , দোকানদার কই ?
লোকটি বলল, আমিই দোকানদার । জন্তুটা কোথা থেকে এল জানি না । দোকান বন্ধ করতে যাব হঠাৎ চমকে উঠে দেখি অদ্ভুদ এক জন্তু সুড়-সুড় করে আমার দোকানে ঢুকে গেল । আমি ভয়ে ছুটে বেরিয়ে এসেছি , নইলে বোধহয় কামড়ে দিত । এইরকম জন্তু আগে কোনদিন দেখিনি । সেই থেকে দরজা লাগিয়ে দাড়িয়ে আছি । ওটা না ধরা অবধি অপেক্ষা করছি , দরজা বন্ধ করতে পারছি না ।
আমরা একধারে আলোচনা করলাম, জন্তুটা কি হতে পারে ? শেয়াল ? ভাম ? বুনো বিড়াল ? বুনো ইঁদুর ? নেকড়ের বাচ্চা ? কি হতে পারে..........?
চুনা বলল, জায়গাটা না দেখলে বলতে পারা যাবে না ।
বন্য জন্তুদের প্রতি কিছু মানুষের অসীম কৌতুহল । সেটা যদি অবার হিংস্র হয় তবে কথাই নেই । তাঁকে খুঁচিয়ে- খুঁচিয়ে পিটিয়ে না মারা অবধি তাদের নিবৃত্ত করা যাবে না । তবে সবাই এতটা নিষ্ঠুর না হলেও তারা স্বচক্ষে জন্তুটাকে চাক্ষুষ করতে চায় । এই দুই ধরনের মানুষকে ঠেকিয়ে বন্য জন্তু উদ্ধার করা সহজ কাহ নয় । চুনাদের মত কিছু কর্মচারী আছে বলে আমাদের কঠিন কাজ অনেক সহজ হয়ে য়ায় । অথচ এই কর্মচারীরদের সংখ্যা দিন-দিন কমছে । আর আমাদের মত অযোগ্য কর্মচারী আর আধিকারিকদের সংখ্যা দিন-দিন বাড়ছে । এটা শুরু হয়েছে চোদ্দ-পনের বছর আগে থেকেই । নেতাদের মতই আমাদেরও এখন চলছে কুর্শীর লড়াই । আমার নমস্য সব দক্ষ আধিকারিকেরা এখন অকেজো বলে ক্ষমতাহীন ।
চুনা-লাল তৈরী হচ্ছে , এদিক- ওদিক মাটি দেখছে। টর্চের আলো ফেলে ওরা জন্তুর পায়ের কোন ছাপ পাওয়া য়ায় কিনা বা কোন সুত্র পাওয়া য়ায় কিনা দেখছে যাতে জন্তু সন্বন্ধে একটা ধারনা হয় । চারিদিক দেখে লাল বললো, কোন চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না , তবে জন্তুটা ছোট কোন জন্তু ।
চুনা চুপচাপ কাজ করে , ওর মুখ দিয়ে সহজে কথা বেরোয় না । কিছু জিজ্ঞেস করলে গঁোফোর নিচে সাদা দাঁতের পার্টি বার করে খুব সংক্ষিপ্ত দুটি-তিনটিশব্দের উত্তর পাওয়া য়ায় । চুনা নিঃশব্দে এদিক-ওদিক ঘুরে, র্টচের আলো ফেলে কিছুক্ষন পর বলল, স্যার শব্দ করতে বারোন করুন, সবাই চুপ থাকলে শব্দ শুনতে পাব ।
সবাইকে ইশারায় চুপ করতে বললাম । পুলিশ আমাদের কর্মকান্ড দেখার উৎসাহে গাড়ী থেকে নেমে পড়েছে । দোকানটার সামনে পাকা রাস্তা , পেছনে একটা ড্রেন , বায়ে সামান্য ফাঁকা , ওর পর পাকা বাড়ী আর দেওয়াল , ডাইনে সরু রাস্তা । আমরা চারিদিক ছড়িয়ে বাড়ীটাকে ঘিরে ফেলেছি । জন্তু পালালেই দেখতে পাব । আমি হাতের লাঠি নিয়ে , কুন্থল বাবু র্টচ নিয়ে , সুরেশ লাঠি নিয়ে , লাল নাইমনের নেট নিয়ে গুছিয়ে তৈরী । যাতে কেনরকমভাবেই চোখে ফাঁকি দিয়ে জন্তুটা পালাতে না পারে । বন্য জন্তু পাগল না হলে বা ভয় না পেলে বা হিংস্র-খুদার্থ না হলে সাধারনত মানুষকে কামড়ায় না । ভয় পেয়ে যে কোনো জন্তু যাকে সামনে পায় তাকেই কামড়াতে পারে । এটাই আমাদের ভয়, যদি আমাদের আগমনে ভয় পেয়ে জন্তুটা ভয় পেয়ে ছুটে আসে ? চাচা আপন প্রা বাঁচা এ-ত্বতে আমি বিশ্বাসী । অতএর নিজেকে অক্ষ রাখতে হাতের লাঠি এখন ক্রিকেটের ব্যাট , আর আমার কাছে ক্রিকেটের বল । ওকে ঠেকানেই আমার আসল কাজ । জন্তু ধরা আমার কাজ নয় । জন্তু ধরবে ছোট কর্মচারীরা আর গলায় মেডেল ঝুলবে আমার ।
চুনা বাড়ীর বিভিন্ন প্রান্তে কান ঠেকিয়ে-ঠেকিয়ে শব্দ শোনার চেষ্টা করছে । লাল , সুভাষেরা নানান ভাবে জন্তুর অবস্থান বোঝার চেষ্টা করে য়াচ্ছে । এইসব ছোট-খাটো কাজে আমার না এলেও হত । আজকাল এই সব কাজ বন রক্ষীরা, বন শ্রমিকেরা করে । রেজ্ঞ অফিসারেরা, বীট অফিসারেরা আজকাল এসব কাজ , পায়ে হেটে বন টহলের কাজ ভুলতে বসতে । তারা বন আধিকারিক ? তা ছাড়া আজকাল এসব উঠকো ঝুট- ঝামেলা কেউ পছন্দ করে না আমি এসেছি কর্মচারীদের পাশে থাকতে অনেকটা উপায়ান্তর না দেখে । আমরা এলে ওরা আনন্দ পায়, সাহস পায় ।
খানিক বাদেই চুনা আমার কাছে এসে চুপি-চুপি বলল, স্যার মনে হচ্ছে একটা কিছু আছে । আপনারা দোকানটার চারিদিকে ঘিরে থাকুন । লাল,তুই আমার সঙ্গে ঝুড়ি আর নেট নিয়ে ভেতরে আয় ।
চুনার হাতে একটা টর্চ আর নেট , লালের হাতে শক্ত একটা ঝুড়ি আর কোমরে বাঁধা টর্চ। বাড়ীর দরজা সাবধানে খুলে ওরা আস্তে-আস্তে ভেতরে ঢুকে পড়ে দরজা আলতে করে বন্ধ করে দিল । সুভাস দরজার কাছে খাঁচা আর টর্চ নিয়ে বসে । আমরা চারিদিক ঘিরে আছি । রাস্তার চারিদিক আলো থাকলেও এই জায়গাটা অন্ধকার । টর্চের আলো জ্বেলে সজাগ দৃষ্টিতে যে যার জায়গা লক্ষ করছি একমনে । দম বন্ধ করা পরিবেশ ।মন পড়ে আছে বাড়ীর ভেতরে চুনা আর লাল এর দিকে । ওখানে কি হচ্ছে কে জানে ?
এ সব কাজে সময়ের কোন সীমা থাকে না । কখন ঝটপট কাজ হয়ে য়ায় কখন অনেক সময় লাগে ।আবার অনেক সময় পরিশ্রম ব্যার্থ হয় , জন্তু পালিয়ে য়ায় । আজকের অভিযানে কি হবে কেউ জানে না ।
বাইরে থেকে চুনার লাঠির শব্দ শুনতে পাচ্ছি । ও জন্তুটাকে ভয় দেখাচ্ছে । ভয় পেয়ে যদি জন্তুটা বরিয়ে পরে তবে পাকড়াও করবে । ঝন-ঝন করে দোকানে কিছু পড়ল মনে হল। দোকানদার অগ্নিমূর্তি হয়ে বলল, হায়- হায় আমার সর্বনাশ করে দিল । আপনারা তো জঙ্গল সাফ করে দিয়েছেন আর এরা কোথায় যাবে ? এখন সব ক্ষতি আমাদের হবে । আপনাদের জন্য আমাদের ঝামেলা । আপনাদের তো মাস ফুরোলে বেতন , আমাদের তো এই দোকানটুকুই সম্বল । কি যে কপালে আছে কি জানি ।
আমাদের সঙ্গে পুলিশ আছে , তার উপর এখন বেশ রাত । ঘড়িতে এখন রাত বারোটা । উৎসাহী মানুষের ভীড় নেই বললেই চলে । এটা আমাদের কাজ করার সুবিধে । দোকানদারের কথা পুরোপুরি মিথ্যা নয় , দায়বদ্ধতা সবার । সবাই সামান্যতম দায়িত্ব পালন করলে ভারতবর্ষের এমন হাল হত না , সে তো হবার নয় ।
ফুটবল খেলার পেলান্টি নেবার সময় গোলকিপার যেমন বলের দিকে তীখ্ষ্ন নজর রাখে তমনি আমরাও এ দোকান বাড়ীর দিকে তেমনিভাবে নজর রাখছি ।হঠাৎ দোকানের দরজায় দরাম – দরাম করে শব্দ হতেই দৌড় আর দৌড় । উৎসাহী জনতা,পুলিশ , এবং আমি লাঠি ফেলে প্রান বাঁচাতে যত জোরে সম্ভব দৌড় লাগালাম । দৌড়াবার সময় বারবার মনে হতে লাগল জন্তুটা ঠিক আমার পেছনেই । কিছুটা দৌড়ে হাঁফাতে-হাঁফাতে পেছন ফিরে দেখি কেউ নেই । পুলিশের সিপাইসহ অফিসার তাদের গাড়ীতে বসে । বিপদ বুঝলেই , পালিয়ে যাবার জন্য তৈরী । জনতার দু-তিনজন হোঁচট খেয়ে মাটিতে । বাকী সব এখনে ছুটছে ।
যখন বুঝলাম ওটা কিছু নয় তখন কর্মচারীদের কাছে লজ্জা পেয়ে ধীরে-ধীরে দোকান ঘরটির দিকে এগিয়ে গেলাম ।
লাল বললো, পেয়েছি স্যর।
উত্তেজিত ভাবে বললাম, কি পেয়েছো ? কোথায় ?
ও বলল, এই বস্তায় আছে ।
--কি জন্তু ?
- বন রুই , স্যর ।
তাড়াতাড়ি বললাম , ঠিক আছে , ওটাকে নিয়ে মিনি জু তে চলে যাও ।
চুনারামেরা বস্তা বেঁধে , খাঁচা সমেত যেতে উদ্যত জল ।হতাশ জনতা । এতক্ষন জেগে তাঁদের হিংস্র জন্তু দেখা হলো না ।
কয়েকজন অনুরোধ করল, স্যর একবার জন্তুটা দেখান না । জন্তুটা একবার দেখব ?
বললাম, আগামীকাল মিনি জুতে যাবেন দেখতে পাবেন । এখানে দেখানো যাবে না। বাইরে বেরিয়ো পড়তে পারে । একবার আবার বেরিয়ে পড়লে অবার ধরা মুস্কিল হবে ।
বনরুইকে বস্তা বন্দী করে লাল, চুনা মটর সাইকেলে চলে গেল । উৎসাহী জনতার উৎসাহ হালকা হয়ে গেল । পলিসের ডিউটি অফিসারকে বললাম, ধন্যবাদ , আমাদের অপারেশন হয়ে গেছে । জন্তুটাকে ঝড়গ্রাম মিনি জু তে পাঠিয়ে দিয়েছি ।
অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, জন্তুটা কি ছিল ?
বললাম, জন্তুটা হিংস্র নয় । পিপীলিকা ভূক প্রানী । এক সময় পশ্চিম মেদিনীপুর,বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, হিমালয়ের পাদদেশে, পাহাড়ের পাদদেশে ঢালু অংশে এবং সমতল জায়গায় এদের সহজেই দেখা যেত । এদের সারা দেহ মাছের আঁশের মত বড়-বড় আঁশ দিয়ে ঢাকা । এই আঁশ বেশ শক্ত , এটা বর্মের কাজ করে এবং বাইরের আঘাত থেকে এদের রক্ষা করে । এই আঁশের বর্ম একে অপরের উপর শক্ত করে থাকে । মাথা , পিঠ ও পাশ ,পুরো ল্যাজ ও পায়ের বাইরের দিক ঘন আাঁশে ঢাকা থাকে । ভয় পেলে এরা সারা শরীর গুটিয়ে বলের আকার ধারন করে । এরা রাতে খাবারের সন্ধানে বেরোয় ।
দিনে বেলা এরা গর্তে বা বড় পাথরের চাঁই এর আড়ালে গুটি-শুটি হয়ে শুয়ে থাকে । ঘুমোনোর সময় এরা সামনের দু পায়ে মধ্যে মাথা রেখে সারা শরীর ল্যাজ দিয়ে ঢেকে শোয় । লম্বায় চার-পাঁচ ফুট হতে পারে ।
এরা ডিম, উঁই পোকা ও পিঁপড়ে খায় । ছুচোলো সরু ও শক্ত মুখ দিয়ে উই এর ঢিপি ভেঙ্গে উই এবং উই এর ডিম খায় । জল পাওয়া গেলে খায় কিন্তু মরু এলাকায় এরা জল ছাড়া অনেকদিন বেঁচে থাকতে পারে ।এই প্রানীর মাংস বহু আদিবাসীদের পছন্দ । এর দেহের আঁশ এবং নানান অংশ শোখিন বস্তু তৈরী করতে ব্যবহৃত হয় । নিরীহ এই প্রানী শিকার করা সহজ । আর এই কারনে এরা বিরল প্রজাতির প্রানী হিসেবে বন্য প্রান সংরক্ষনের তালিকায় স্থান পেয়েছে । বনরুই বা প্যাঙ্গোলিন দেখতে ভয়ঙ্কর হলেও এরা আসলে হিংস্র নয় , বড্ড ভীতু । পরদিন ঝাড়গ্রাম মিনি জু’তে অদ্ভূত জন্তু দেখতে দর্শক বেড়ে গেল কয়েকগুন।