শান্তিনিকেতনে আজও ছড়িয়ে রয়েছে সেই সব স্বপ্ন। আজ সেইসব বাড়ির কথাই বলি।জোড়াসাঁকোর একান্নবর্তী পরিবারে একেবারে নিজের বলতে তো একটি ঘর আর অবসর বলতে তেতলার ছাদখানি ছিল। শিলাইদহে একলার সংসার ছিল রবিঠাকুরের। সংসার সামলাতেন মৃণালিনী দেবী। আর রবীন্দ্রনাথ? পদ্মানদীতে ভাসমান বজরায় একলা হয়েই মগ্ন হতেন লেখার কাজে। এক দার্শনিক কবির এই একলা হওয়ার উপযুক্ত পরিসর সত্যিই প্রয়োজন। শান্তিনিকেতনের আনাচে কানাচে রূপ পেয়েছে কবির খেয়াল। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা ছাড়াও ভুবনডাঙার ব্যপ্ত আকাশ জানে রবীন্দ্রনাথের ঘর তৈরির গল্প। আজ শুধু ইমারতগুলি চোখে পড়ে। প্রতিটি বাড়ি তৈরির অন্তরালে রবি ঠাকুরের আবেগ অধরাই রয়ে যায়। বাড়ির নামগুলিও বড়ো সুন্দর। নামগুলি যেন ইঁটপাথরের ইমারতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে।মস্ত প্রাসাদের মতো বাড়িটির নাম উদয়ন।
১৯১৯ সালে এই বাড়ির নির্মাণ শুরু হয়। অনেক পরিকল্পনা আর অদলবদলের পর ১৯২৮ সালে সম্পূর্ণ হয় এই বাড়ি। একতলার ঘরটি সাজানো হয়েছিল জাপানি রীতিতে। বালি, বরবুদুর, গুজরাট ইত্যাদি অঞ্চলের স্থাপত্য জায়গা পেয়েছিল উদয়নের সাজসজ্জাতে। রবীন্দ্রনাথ ও দেশবিদেশের নানা গুণী মানুষের কথালাপ যেন ছড়িয়ে আছে এই বাড়ির আনাচেকানাচে। উদয়নের বারান্দায় কবির শেষ জন্মদিন পালন করা হয়েছিল। আর এই বাড়ি থেকেই কবিকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জীবনের শেষবেলায়। উত্তরায়ণের প্রথম বাড়ি কোণার্ক। প্রথমে মাটির দেওয়াল আর খড়ের চাল দিয়ে তৈরি এই বাড়ির নাম দেওয়া হয় পর্ণকুটির। ১৯১৯ সালে কবি এই বাড়িতে থাকতে আসেন। তখন থেকে অনেক পরিবর্তনের পর অবশেষে তৈরি হল বর্তমানের পাকা বাড়ি কোণার্ক। প্রতিমাদেবী বহুদিন বাস করেছেন এখানে। দীনবন্ধু এন্ড্রুজকেও থাকতে দেওয়া হয়েছিল এই বাড়িতে। বড়ো বড়ো বাড়ির মাঝে স্নিগ্ধ এক বাড়ির নাম শ্যামলী। মাটির দেওয়াল আর মাটির ছাদ — এই বাড়ির বৈশিষ্ট্য। বীরভূমের শুকনো আবহাওয়ায় আগুনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে এই বাড়িতে। মাটির কলসীর উপর কলসী চাপিয়ে বিচিত্র উপায়ে তৈরি হয়েছিল এই বাড়ি। কবিকল্পনা বাস্তবায়িত করেছিলেন নন্দলাল বসু, সুরেন কর, রামকিঙ্কর বেজের মত মানুষেরা। কলাভবনের ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে শ্যামলীর দেওয়াল হয়ে ওঠে চিত্র বিচিত্র। ১৯৩৫ সালে কবির জন্মদিনে এই বাড়ির গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠান হয়। ১৯৪০ সালে গান্ধিজি সস্ত্রীক বাস করে গিয়েছিলেন এই বাড়িতে। কোণার্ক বাড়ির পুবদিকে ছোট একতলা বাড়ির নাম ছিল পুনশ্চ। এই বাড়ির দেওয়াল মাটির হলেও ছাদ ছিল কংক্রিটের। পুনশ্চ বাড়িতে একটি খোলামেলা ঘর ও চারিদিকে খোলা বারান্দা ছিল। রথীন্দ্রনাথের পরিকল্পনায় সামনের গোলাপ বাগান থেকে সিঁড়ি উঠে গিয়েছিল খোলামেলা ঘর পর্যন্ত। রাজস্থানী খোলা জানালা আর সিঁড়ি সংলগ্ন পলাশ গাছ ছিল বাড়িটির বৈশিষ্ট্য। এখন একবাড়িতে বেশিদিন থাকতে কবির মোটেও ভালো লাগত না। শ্যামলী বাড়িতে একবছর কাটিয়ে পুনশ্চ বাড়িতে দুইবছর থাকলেন কবি। পরে অবশ্য পুনশ্চকে সাধারণ ঘরের মতো বানিয়ে ফেলা হয়। পুনশ্চর চারদিক খোলা ঘরের আদলেই তৈরি হল ‘উদিচী’ বাড়ি। প্রথমে অবশ্য এর নাম ছিল ‘সেঁজুতি’। পরে নামবদল হয়। এই বাড়ির সামনে ছিল গোলাপ বাগান। কোণার্ক-শ্যামলী-পুনশ্চ-উদয়ন-উদীচী—এই পাঁচটি স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি নিয়ে উত্তরায়ণ।এছাড়া কিছু ভবন আছে, যার সবগুলি ঠিক থাকার জন্য তৈরি না হলেও বেশ উল্লেখযোগ্য। উপাসনা মন্দিরের ঠিক উত্তরপূর্ব কোণে একটি তালগাছকে কেন্দ্র করে গোলাকৃতির খড়ের চালের বাড়ি আছে। এইটিকে তালধ্বজ বলা হত। এখন এটি কারুসংঘের মহিলাদের কার্যালয়। আম্রকুঞ্জের ঠিক দক্ষিণ কোণে একটি ছোটো দোতলা বাড়ির নাম দেহলি।
রবীন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতনে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন, তখন এই বাড়িটি তৈরি হয়েছিল। এখন এটি ‘মৃণালিনী পাঠশালা’। দেহলি বাড়ির পাশে আর একটি খড়ের বাড়ি আছে, তাকে ‘নতুন বাড়ি’ বলা হয়। নতুন বাড়ির পশ্চিমে আর একটি খড়ের চালের বাড়ি। এখন তা ‘আলাপিনী মহিলা সমিতি’। এখন যেখানে বিশ্বভারতীর স্নাতক বিভাগের মেয়েদের হোস্টেল আছে, আগে সেখানে ‘দ্বারিক’ নামে একটি বাড়ি ছিল। এখন অবশ্য তার কোনো অস্তিত্ব নেই। চৈতি নামের একটি কালো বাড়ি আছে। বাড়িটির মাটির দেওয়াল, মাটির চাল। এই বাড়ির গঠন দেখে গ্রামের মানুষ যাতে শিখতে পারে, আগুনের হাত থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায়, তাই নাকি এই বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিল। আরেকটি বাড়ির নাম ব্ল্যাক হাউস। মাটির তৈরি, আলকাতরার প্রলেপ দেওয়া বাড়ি। নন্দলাল বসু আর রামকিঙ্কর বেজের যৌথ উদ্যোগে এই বাড়িটির দেওয়াল অলঙ্কৃত করেন কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা। মালঞ্চ বাড়িতে থাকতেন রবীন্দ্রনাথের ছোট মেয়ে মীরাদেবী। এই বাড়ির উদ্যানের আয়তন ২০ বিঘা। এখন এটি হেরিটেজ বিল্ডিং। কলাভবন, রবীন্দ্রভবনে মূল্যবান সব শিল্পকর্ম রাখা আছে। নন্দন নামের আর্ট গ্যালারি উদ্বোধন করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধি।বর্তমানে যেটি ‘বিশ্বভারতী অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশন’-এর কার্যালয়, সেটির নাম ছিল বেণুকুঞ্জ। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ের পর কিছুদিন এখানে বাস করেছিলেন। বেণুকুঞ্জের দক্ষিণে আটকোণা ঘরটি ‘দিনেন্দ্র স্মৃতি চা-চক্র’। দিনেন্দ্রনাথের স্ত্রী কমলাদেবীর প্রতিষ্ঠিত এই চা চক্রের আরেকটি নাম ‘দিনান্তিকা’। শিক্ষক সন্তোষচন্দ্র মজুমদারের নামে রয়েছে ‘সন্তোষালয়’। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের তৈরি একটি বাড়ি হল ‘মুকুটঘর’। চীনাভবনের বারান্দার দেওয়ালে সত্যজিৎ রায়ের আঁকাও রয়েছে। চীয়াং কাইশেন আর তান য়ুন শানের উদ্যোগে এই ভবনটি তৈরি। এটি চীন-ভারত সংস্কৃতির আদর্শ পীঠস্থান।
হিন্দীভবনের দেওয়াল চিত্র এঁকেছিলেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করতেন যেখানে, সেই বাড়ি এখন বিখ্যাত ‘দ্বিজবিরাম’ নামে। রতনকুটি এখন বিশ্বভারতীর ভিআইপি গেস্ট হাউস। শিল্পসদন হল শিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।তবে শান্তিনিকেতনের আদি বাড়ি হল ছাতিমতলায়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এই ছাতিমতলাতেই প্রথম প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ আর আত্মার শান্তি পেয়েছিলেন। ১৮৬৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ রায়পুরের জমিদারের কাছে ২০ বিঘা জমি গ্রহণ করার পর এখানে আত্মীয় পরিজনদের নিয়ে এসে ঈশ্বর সাধনা করবেন বলেই এই দোতলা বাড়ি তৈরি করান। এই বাড়িটি জোড়াসাঁকোর বাড়ির আদলে তৈরি। রবীন্দ্রনাথ উপনয়নের পর এই বাড়িতেই এসে ছিলেন। ১৮৯২ সালে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল উপাসনা গৃহ। এই উপাসনা সভা বসত শুভ্র পোশাকে, প্রতি বুধবার। সর্বধর্ম সমন্বয় এই উপাসনার বীজমন্ত্র।রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবন মৃত্যুশোক, স্বজন হারানোর যন্ত্রণায়, বিষাদে ভরাট। শান্তিনিকেতনের মাটিতে জেগে ওঠা এই বিচিত্র শৈল্পিক ভবনগুলিকে আমরা এক অনিকেত মানুষের স্বপ্ন বলতে পারি।