ঢাকা জাকির হোসেন : 'তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার', 'কে বলেছে? সরকার। কী বলেছে? রাজাকার', 'চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার' -গত মধ্যরাতে এই স্লোগানগুলোতে প্রকম্পিত হয়েছে পুরো বাংলাদেশ৷ কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে দেশের পড়ুয়া তথা শিক্ষার্থীরা দলে দলে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে৷ দিনের আলোয় শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের অংশ হিসেবে আবারও মিছিলে নামলে তাদের দমাতে মাঠে নামে পুলিশ৷ পাশাপাশি শাসকদল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন 'ছাত্রলীগ' আবির্ভূত হয় সন্ত্রাসীর ভূমিকায়৷ অভিযোগ উঠেছে, বহিরাগত উঠতি কিশোর ও সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে ধারালো সব দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাত্রলীগ৷ বাদ যায়নি নারী শিক্ষার্থীরাও৷ রক্তাক্ত হয় গোটা বাংলাদেশ৷ ১৪ জুলাই রবিবার রাত ১১টা নাগাদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে৷ মিছিল ও শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি শেষে শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে যায়৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলসহ প্রত্যেকটি হলের শিক্ষার্থীরা এই বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেয়। সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল, কবি জসিম উদ্দিন হল, বঙ্গবন্ধু হল, জিয়াউর রহমান হল সহ বিজ্ঞান অনুষদের হলগুলোর হাজার হাজার শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে বের হয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে ও স্লোগানে মুখর করে তোলে ঢাকার রাজপথ। এদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মিছিলে যোগ দেওয়া ঠেকাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হল, মাস্টারদা সূর্যসেন হল, বিজয় একাত্তর হল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ও স্যার এ. এফ. রহমান হলের শিক্ষার্থীদেরকে আটকে রাখার চেষ্টার অভিযোগ ওঠে হলগুলোর ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু অন্যান্য হলের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে এসে এই হলগুলোর মূল গেটের তালা ভেঙে আগ্রহী শিক্ষার্থীদেরকে উদ্ধার করে মিছিলে যুক্ত করেন। উল্লেখ্য, ছাত্রলীগ হচ্ছে বাংলাদেশের শাসকদল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন৷ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, "সূর্যসেন হল, মুহসীন হল, বিজয় একাত্তর হল, স্যার এ. এফ. রহমান হল ও সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে আটকে রাখা শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করে মিছিলে যুক্ত করা হয়। জহুরুল হক হলের টিভি রুমে শিক্ষার্থীদের আটকে রাখা হয়েছিল তবে প্রতিটি হলই স্লোগানে স্লোগানে মুখর ছিল৷" বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক রিফাত রশিদ বলেন, "বিজয় একাত্তর হলের গেটে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আটকে রেখেছে -এমন খবর পেয়ে তাদের বের করে আনতে গিয়েছিলেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। সেখানে তার ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।" আন্দোলনে অংশ নেওয়া আরেক শিক্ষার্থী জানাল, "দেশের অধিকাংশ মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা কোটা সহ সব কোটার সংস্কার চায়৷ দেশের মানুষ চায় মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ হোক।" এদিকে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) রাজু ভাস্কর্য থেকে মশাল মিছিল করে একদল শিক্ষার্থী। তাদের একজন বলল, "আবাসিক হলগুলোর সামনে হল শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ পদপ্রত্যাশীরা অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে যোগ দিতে বাধা দেয়৷ কিন্তু বাধা দিয়ে কাজ হয়নি। শিক্ষার্থীরা হলগুলোর গেটে জড়ো হয়ে হলের গেট ভেঙে বের হয়ে এসে বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেয়।"
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির রাষ্ট্রীয় তথা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি জানিয়ে যখন সারাদেশে সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া ও চাকরিপ্রত্যাশীরা সরব, ঠিক সেই মুহূর্তে ১৪ জুলাই রোববার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, "মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নাতিপুতিরা কেউ মেধাবী না তো কি যত রাজাকারের বাচ্চারা নাতিপুতিরা মেধাবী তাই না? কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যাদেরকে মেধাবী না বলছে, তাদের হাতে কিন্তু পরাজিত হয়েছিল৷...তাহলে তাদের মেধাটা কোথায়?" প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের বক্তব্য হচ্ছে, "কোটা সংস্কারের দাবিতে পুরো দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা আন্দোলন করছে৷ আন্দোলনকারীদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানরাও রয়েছে৷ আমরা কোটাব্যবস্থা সংস্কারের কথা বলছি৷ আমরা বলছি না যে কার মেধা আছে আর কার মেধা নেই৷ আমরা বলছি কোটা সংস্কার হোক, বিস্তৃতভাবে মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে সব ধরনের নিয়োগ হোক৷ কোটা রাখলে তা ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসুক৷ ১০০ ভাগের ৫৬ ভাগই যদি কোটায় নিয়ে যায় তবে সাধারণদের জন্য বাকি আর কী থাকে! ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে দেশের প্রধানমন্ত্রী এরকম একটা মন্তব্য করেছেন যে আমাদের দেশভক্তি নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলছেন! অথচ আমরা আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে মনেপ্রাণে লালন করে চলেছি এবং আমরা রাজাকার পরিবারেরও সন্তান নই৷ কোটা সংস্কার বাংলাদেশের গণমানুষের লড়াই৷ কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর লড়াই না৷"
শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে খোদ তার দল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের ছয় নেতা পদত্যাগ করলেন! পদত্যাগকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পদধারী ছিলেন৷ তারা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখা ছাত্রলীগের গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন সম্পাদক মাছুম শাহরিয়ার, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট শাখার মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণাবিষয়ক উপ-সম্পাদক রাতুল আহমেদ শ্রাবণ, কলাভবন ছাত্রলীগের এক নম্বর সহ-সম্পাদক মোহাম্মদ মুহাইমিনুল ইসলাম, আইন অনুষদ শাখার গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক আশিকুর রহমান জিম, কবি জসীমউদ্দীন হলের রাসেল হোসেন এবং রাফিউল ইসলাম রাফি।
এদিকে রাত আড়াইটার দিকে রাস্তায় নেমে আসে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন হল থেকে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে বুয়েট শহীদ মিনারের সামনে জড়ো হন তারা। এরপর সেখান থেকে মিছিল নিয়ে পলাশী-নীলক্ষেত-উপাচার্য চত্বর-টিএসসি হয়ে পুনরায় বুয়েট ক্যাম্পাসে মিলিত হন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা কলেজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের প্রায় সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে মধ্যরাতে হল ছেড়ে রাজপথে নেমে আসে৷ বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের স্লোগানে স্লোগানে, প্রতিবাদের অগ্নিটংকারে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো দেশ৷ এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে দুইজন আহত হয়েছেন। মধ্যরাতে ক্যাম্পাসের কাটা পাহাড় সড়কে এই ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত সোয়া ১১টার দিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্টে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভে 'তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার', 'চেয়েছিলাম ন্যায় বিচার, হয়ে গেলাম রাজাকার' প্রভৃতি স্লোগান দেয় শিক্ষার্থীরা। পরে রাত সাড়ে ১১টার দিকে ছাত্রলীগের ৪-৫ জন নেতাকর্মী কাটা পাহাড় এলাকায় আসে। সেখানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মাঝেই কয়েকটি বাজি ফোটায় তারা। এরপর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পিছু হটে। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা কাটা পাহাড় দিয়ে শহীদ মিনারের দিকে মিছিল নিয়ে যাওয়ার পথে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ধাওয়া করে। পরে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তখন অন্তত চার থেকে পাঁচজনকে মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আহত দুজন হলেন—সুমন ও সুমাইয়া। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী শারমিন সুলতানা বলেন, "কোটা সংস্কারের আন্দোলনে হঠাৎ ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী লাঠি নিয়ে হামলা করেন। আন্দোলনরত কয়েকজনকে চড়-থাপ্পড় মারেন। নারী শিক্ষার্থীদের গালাগাল করেন। এতে প্রায় চার-পাঁচজন আহত হন। পরে একে একে সব পক্ষের নেতাকর্মীরা জিরো পয়েন্টে আসেন। সেখানে গিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন।"
এদিকে শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মাঝেই শাসকদলের কয়েকজন মন্ত্রী বিরূপ মন্তব্য করেছেন যা নিয়ে বইছে সমালোচনার ঝড়৷ সমাজকল্যাণ মন্ত্রী দীপু মনি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নিশানা করে বলেন, "লাল-সবুজের পতাকা নেওয়ার অধিকার তাদের নেই৷" ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক রোববার দিবাগত রাতে দেওয়া এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, "আছিস যত রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়৷" আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া পৃথক এক পোস্টে পলক লিখেছেন, "যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ মার্চ ছাত্র শিক্ষকদেরকে গণহত্যা করেছে রাজাকাররা, সেই রাজাকারের পক্ষে রাজাকারের সন্তান বলে শ্লোগান দিতে লজ্জা করে না?" শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য করে লেখেন, "যারা প্রকাশ্যে নিজের আত্মপরিচয়, জন্মপরিচয়, ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে, ‘তুমি কে, আমি কে; রাজাকার! রাজাকার!’ স্লোগান দিয়েছে, এরা সবাই এই যুগের রাজাকার।"
তিনি আরও লেখেন, "এদের আওয়াজে বিভ্রান্ত হলে চলবে না! এ যুগের রাজাকারদের পরিণতি ঐ যুগের রাজাকারদের মতই হবে! ঘৃণা, ধিক্কার, আর ক্রোধ এদের প্রতি! রাজাকারের দল তোরা, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ছাড়!" সরকারের মন্ত্রীদের এরকম মন্তব্য ঘিরে সাধারণ মানুষের মাঝে তীব্র সমালোচনার উন্মেষ হচ্ছে৷ পেশায় চিকিৎসক ও সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক যুবায়ের আহমেদ ফেসবুকে লিখলেন, " 'মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরাও পাবে না। তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?' অথচ আন্দোলনটা ছিল কোটা সংস্কারের। আন্দোলনে এই পর্যন্ত তো কেউ কোটা বিলুপ্তির দাবি করে নাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকেই 'তুই রাজাকার তুই রাজাকার' স্লোগান বের হইসিলো একসময়৷ সরকারের সিদ্ধান্তের বিপরীতে কেউ মত দিলেই রাজাকার ট্যাগ দেওয়ার এই যে রাজনৈতিক ট্রেন্ড ফেসবুকে দেখি, এটা এতটাই প্রকট যে সেই ঢাবি থেকেই এখন স্লোগান বের হচ্ছে 'আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার'। মাঝে মাঝে রাজাকার ট্যাগ দেওয়া দেখে মনে হয় যে কেউ কেউ পারলে বলেই ফেলে -যার মুক্তিযোদ্ধা কোটা নাই, সবাই রাজাকার। এইজন্যই তো দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধার বয়স পাওয়া যায় পঞ্চাশের কম যেখানে দেশটার বয়স ৫৩ ক্রস করে গেছে৷ একটা মেয়েকে যদি বারবার বারবার চরিত্র নিয়ে দোষারোপ করতে থাকেন, এক সময় সে বলে বসবে - ওকে ফাইন আমি একটা পতিতা। এখন খুশি? এই কথাটায় কি লিটারাল মিনিং ধরবেন না হিডেন আক্ষেপ কাউন্টে নেবেন৷ ঢাবি যে আজকে স্লোগানটা দিল, কতটা আক্ষেপ হইলে এসব স্লোগান কেউ দেয়।"
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে একাত্মতা জানিয়ে এবার রাস্তায় নেমেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। ১৫ জুলাই সোমবার সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে৷ বিক্ষোভে অংশ নেয় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, আআহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রিন বিশ্ববিদ্যালয় সহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা৷ তাদের হাতে কোটা সংস্কারের দাবি সংবলিত বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড দেখা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীদের ওপর বিস্তৃতভাবে হামলা করে ছাত্রলীগ৷ এতে আহত হওয়া কয়েকশ' শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে৷ চট্টগ্রামে কোটা আন্দোলনের সমন্বয়ক তালাত মাহমুদ রাফিকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে ছাত্রলীগের কর্মীরা৷ আন্দোলনকারীদের ওপর সবচেয়ে বড় হামলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়৷ ১৫ জুলাই বিকেল তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনে ছাত্রলীগ হামলা করে আন্দোলনকারীদের ওপর৷ বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে রাজু ভাস্কর্যের সামনে কোটা আন্দোলনকারীরা মাইকে ঘোষণা করে বলে, "আমাদের ওপর যদি আক্রমণ হয়, তাহলে আমরা পাল্টা আক্রমণ করব। আমরা পিছু হটব না।" পরে মাইকিং করে শিক্ষার্থীদের উপাচার্য চত্বর এলাকায় যেতে বলা হয়। উপাচার্য চত্বরের সামনেই সাড়ে ৩টা থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর ধারালো চাপাতি, রামদা, লাঠিসোটা সহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও তাদের ভাড়া করে আনা বহিরাগত সন্ত্রাসীরা৷ ভিসি চত্বর, মল চত্বর, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি), শাহবাগ, নীলক্ষেতে অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের ওপর মুহুর্মুহু হামলা চালায় ছাত্রলীগ৷ মারাত্মকভাবে আহত হয় প্রায় সাতশ' শিক্ষার্থী৷ আহতদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে৷ এদের মধ্যে প্রায় দুইশ' শিক্ষার্থীর অবস্থা আশঙ্কাজনক৷ তারা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে বলে জানিয়েছেন কর্তব্যরত চিকিৎসকরা৷ এই আহত শিক্ষার্থীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেলে সেখানে আবারও তাদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা৷ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া সাধারণ মানুষের ওপরও হামলা করে ছাত্রলীগ৷ হাসপাতালের আনসার সদস্যরা মাইকিং করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বের হয়ে যেতে বলে। প্রায় ১০ মিনিট মারধরের পর সন্ধ্যা ৭টা ২৭ মিনিট নাগাদ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যায়। এরপর হাসপাতাল ভবনের দরজা বন্ধ করে দেয় হাসপাতালের কর্মীরা। পরে আবারও হাসপাতালের গেট ভেঙে ছাত্রলীগ হামলা শুরু করে৷ এসময় বেশিরভাগ ছাত্রলীগ কর্মী হেলমেট পরে ছিল, তাদের হাতে ছিল দেশীয় ধারালো অস্ত্র। এই হামলায় ঢাকা মেডিকেলের কয়েকজন ইন্টার্ন চিকিৎসকও আহত হন৷
আন্দোলনরত ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরাও রেহাই পায়নি ছাত্রলীগের হামলা থেকে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে বিক্ষোভে যাওয়ার সময় ইডেন মহিলা কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে ও বাধা দিয়েছে। এই হামলায় কয়েকশ' ছাত্রী আহত হয়েছেন বলেও জানান তারা। মিছিলরত শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে গরম জল ছুঁড়ে মারে ছাত্রলীগের কর্মীরা৷ এসময় গরম পানির তীব্রতায় মারাত্মকভাবে ঝলসে কয়েক নারী শিক্ষার্থীর মুখ ও শরীরের অংশ৷
ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয়েছেন বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের আলোকচিত্র সাংবাদিক প্রবীর দাশ, প্রথম আলোর সাংবাদিক দীপু মালাকার সহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও৷ সোমবার বিকেল পৌনে চারটা নাগাদ উপাচার্য চত্বরের সামনে ছাত্রলীগের কর্মীদের ছোঁড়া ইটের আঘাতে আহত হন তারা৷
এছাড়া দেশজুড়ে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই আন্দোলনকারীদের ওপর বিচ্ছিন্নভাবে হামলা করে ছাত্রলীগ৷ কুড়িগ্রামে কোটা সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক অনিরূদ্ধ প্রনয়, যুগ্ম আহ্বায়ক সাদিকুর রহমান এবং রতন অধিকারী সহ কয়েকজনকে মারাত্মক জখম করে ছাত্রলীগ৷ তারা বর্তমানে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন৷ দেশজুড়ে ছাত্রলীগের এই সিরিজ হামলার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যে প্রতিবাদের ঝড় তুলতে শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে৷ বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসছে, লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় মহাসড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিল করছে৷ দাবি আদায় না হওয়া অবধি রাজপথ ছাড়বে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে আন্দোলনকারীরা৷
দেশজুড়ে ছাত্রলীগের সিরিজ হামলার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই মঙ্গলবার বিকেল তিনটায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ মিছিল এবং সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। ১৫ জুলাই সোমবার রাত সাড়ে ন'টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বরে কোটাবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদুল ইসলাম এই কর্মসূচির ঘোষণা দেন। নাহিদুল বলেন, "শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা-মামলা, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার ও কোটা বাতিলের এক দফা দাবিতে সারা দেশে আগামীকাল ১৬ জুলাই মঙ্গলবার বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এরপরও যদি কোটা বাতিল করা না হয় তবে পরে সারা দেশে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।" তিনি বলেন, "আজ পরিকল্পিতভাবে বহিরাগতদের এনে আমাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর থাকার পরও বহিরাগতরা কীভাবে হামলা করে? সরকার সহিংসভাবে এই আন্দোলনকে দমন করতে চাইছে। কোটা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই। আমরা বলতে চাই অবিলম্বে এই বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে ছাত্র সমাজের কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে হবে।" ১৬ জুলাই মঙ্গলবারের আন্দোলনে সারা দেশের মানুষকে নেমে আসার আহ্বানও জানান তিনি৷ এ সময় কোটা আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, "সারা দেশে মর্মান্তিকভাবে আমাদের ওপর হামলা চালানো হলো। এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং প্রক্টর আমাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।"
এখন দেখার বিষয়, দেশজুড়ে এই ঝড়-পাল্টা ঝড় কোথায় গিয়ে দাঁড় করায় বাংলাদেশকে৷ সার্বিক পরিস্থিতিতে পুরো দেশজুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজমান৷ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, দেশের মানুষের মুখে মুখে একটাই রব উঠেছে, "স্বৈরাচারি শাসক হাসিনা ও তার দল স্বৈরাচারি আওয়ামী লীগের পতন ঘটাও, দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও৷"