Skip to content

বাংলা ও বাঙালির কবি অসীমদা'র প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য!

কবি অসীম সাহা (১৯৪৯–২০২৪)

ঢাকা জাকির হোসেন : দুই বাংলার জনপ্রিয় কবি অসীম সাহা চলে গেলেন না-ফেরার দেশে৷ যাবার সময় যা দিয়ে গেছেন, তা বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যের জন্য এক বিশাল পাওয়া আর তাঁকে হারানো আমাদের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি৷

অসীম সাহা ১৯৪৯ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের নেত্রকোণা জেলায় তার মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস মাদারীপুর। তাঁর পিতা অখিল বন্ধু সাহা ছিলেন অধ্যাপক। অসীম সাহা ১৯৬৫ সালে মাধ্যমিক পাস করেন এবং ১৯৬৭ সালে মাদারীপুর নাজিমুদ্দিন মহাবিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৯ সালে স্নাতক পাস করে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে৷ ১৯৬৯ সালে অসহযোগ আন্দোলন এবং পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তার স্নাতকোত্তর পরীক্ষা পিছিয়ে যায় এবং ১৯৭৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: পূর্ব পৃথিবীর অস্থির জ্যোৎস্নায় (১৯৮২), কালো পালকের নিচে (১৯৮৬), পুনরুদ্ধার (১৯৯২), উদ্বাস্তু (১৯৯৪), মধ্যরাতের প্রতিধ্বনি (২০০১), অন্ধকারে মৃত্যুর উৎসব (২০০৬), মুহূর্তের কবিতা (২০০৬), Refugee and the festival of death in darkness (২০১০), সৌর-রামায়ণ (২০১১), অক্টাভিও পাস ও ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা (অনুবাদ) (২০১১), কবর খুঁড়ছে ইমাম (২০১১), প্রেমপদাবলি (২০১১), পুরনো দিনের ঘাসফুল (২০১২) (কবিতা), প্রগতিশীল সাহিত্যের ধারা (১৯৭৬), অগ্নিপুরুষ ডিরোজিও (১৯৯০), উদাসীন দিন (উপন্যাস) (১৯৯২), শ্মশানঘাটের মাটি গল্প (১৯৯৫), কিলের চোটে কাঁঠাল পাকে (২০০২), শেয়ালের ডিগবাজি (২০০৭), হেনরি ডিরোজিও (২০১০)৷

তাঁর সাথে আমার সম্পর্কটা ছিলো অনেকটা আপন ভাইয়ের মতো৷ তিনি ছিলেন আমার বড় ভাই৷ 'দাদা' সম্বোধন করতাম৷ আমার পুত্র তাঁকে 'দাদু' সম্বোধন করতো৷ আমার এটা ভেবে ভালো লাগে আমার এই একমাত্র পুত্রসন্তানও একজন তরুণ কবি৷ ওর কবিতার বই 'আঁচড়কাটার দল' এ বছর বাংলাদেশের 'অমর একুশে বইমেলা'তে প্রকাশিত হয়েছে ও ব্যাপক সাড়া ফেলেছে৷ যাই হোক, শেষবার পুত্রকে নিয়ে অসীমদা'র সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম গত ফেব্রুয়ারি মাসের ২৪ তারিখ৷ সেদিনও তিনি হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছিলেন৷ তাঁর শারীরিক অবস্থার দিন দিন অবনতি হচ্ছিল৷ আর্থিক সংকটে দাদার চিকিৎসা ব্যাহত হয়েছে বেশ -আমাদের জন্য এ এক যথেষ্ট লজ্জার৷ তাঁর চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রায় দু' মাস হয়ে গিয়েছিল তখন, এরপরেও চিকিৎসার জন্য অর্থের চেক তাঁর পরিবারের হাতে পৌঁছাতে অনেক সময় লেগেছে৷ যেদিন দেখতে গিয়েছিলাম, একদিন আগেই তাঁর রিলিজ হবার কথা৷ কিন্তু হাসপাতালের বকেয়া থাকায় তাঁর রিলিজ হতে আরও দুদিন লেগেছিল৷ সংবেদনশীলসহ যেকোনো বিষয়ে রাষ্ট্রীয় আমলা তথা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের গাফিলতি কোনোভাবেই কাম্য নয়৷ কিন্তু বারংবার আমরা ঠিক সেটাই দেখে আসছি৷ প্রধানমন্ত্রী হাসিনার নির্দেশনার পরও একটা অর্থের চেক একজন প্রথিতযশা কবিকে হস্তান্তর করতে এত দীর্ঘসূত্রিতা কবির জন্য এক বিশাল অপমান৷ এবার অসীমদা গত ২১ মে হাসপাতালে ভর্তি হন। তখন থেকে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। ১৫ জুন শনিবার তাঁর অধিকতর চিকিৎসার জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে পারকিনসন, চরম কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি৷ জীবনের শেষ সময়টাতে দাদা প্রচুর অবহেলা পেয়েছেন তাঁর স্বদেশ থেকে, মানুষের থেকে৷ কবি মানেই কবিতাকে হাতিয়ার করে মানুষের কথা বলে, প্রান্তিকতার কথা বলে, আলোর দিশা দেখিয়ে সমাজ বদলানোর আর বিপ্লবের কথা বলে৷ দিনশেষে একজন কবিকে যদি আমরা সামান্য পরিমাণ সম্মানটুকু না দিতে পারি তাঁর মৃত্যুর আগে, তবে মৃত্যুর পরে মেকি কান্না করে আর শ্রদ্ধা দেখিয়ে কী বুঝাতে চাই আমরা?

অসীমদা'র ছেলে অর্ঘ্য'র থেকে শুনলাম, অসীমদা বলে গেছেন তাঁর মরদেহ দান করে দিতে৷ কতো বড় ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন দাদা! আপনার জীবনটা পুরোই ত্যাগে ভাস্বর৷ আর আমরা আপনাকে একবুক শূন্যতা, অবহেলা, অপমান ছাড়া কিছুই দিতে পারিনি আপনার জীবদ্দশায়৷ আমরা বরাবরই সবার সাথে এরকম৷ বেঁচে থাকতে আমরা মানুষের কতোটা মূল্যায়ন করি একবার কি আমরা ভেবে দেখেছি? আর যদি ভেবে দেখিও তা খুবই ক্ষণিকের, পরে আবার ভুলে গিয়ে পুরনো চিত্তে ফিরে আসি৷

অসীমদা আপনি ভালো থাকুন৷ দুই বাংলায় আপনার যে পরিমাণ জনপ্রিয়তা, তা কল্পনাতীত৷ আমি দেখেছি, সাহিত্যের আঙিনায় যত মানুষ আনাগোনা করেন, তাঁদের কাছে আপনার আকাশসমান কদর ছিল সবসময়৷ আলোকিত মানুষেরা কখনো পথ হারায় না, তাঁরা অন্ধকারেও পথ দেখায় অবিরত৷ অসীমদা এক অবারিত আলোর ধারক ও পথযাত্রী, দেশ মানু্ষ ও পৃথিবীর জন্য৷ দেশ, মানুষ ও পৃথিবীকে কেন্দ্র করে তিনি লিখতেন৷ এই দেশ, মানুষ ও পৃথিবীর কাছে তাঁর দায়বদ্ধতা তিনি যথাযথ পালন করতে পেরেছেন৷ একটা মানবিক পৃথিবীর জন্য লড়াইয়ে তিনি ছিলেন অগ্রগামী এক সৈনিক৷ শেষে নিজের দেহটাও মানবকল্যাণে দান করে দিয়ে গেলেন মানুষের প্রতি অসীম প্রেমের তেজে৷ চিত্তের গহীন থেকে এই অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো মানুষের মধ্যে জন্মায়৷ অসীমদা'র অভাব কখনও পূরণ হবার নয়৷ বাঙালি জাতিসত্তার এক অনিন্দ্য ধূমকেতু একজন অসীম সাহা৷ বাঙালির আনন্দ-বেদনার চিরদিনের কাব্যের অমর কবিদের একজন অসীম সাহা৷ যতোকাল বাংলা ভাষা থাকবে, যতোকাল বাংলা ভাষাভাষী মানুষ থাকবে, যতোকাল অন্তত একজন হলেও প্রকৃত বাঙালির বিচরণ থাকবে এই পৃথিবীর বুকে -অসীমদা'র নাম আলোকতেজ ও মায়ায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে বাঙালির প্রতিটি উদযাপনে, সফলতায়, শক্তিতে, দ্রোহে বিপ্লবে, গানে, গল্পে, কবিতায়, রন্ধ্রে রন্ধ্রে, পথপ্রজন্মে, অসীমে৷ প্রিয় অসীমদা,
"এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান৷"

কলমে : জাকির হোসেন (লেখক,সাংবাদিক, কবি, প্রাবন্ধিক, মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা গবেষক)

গুরুতর অসুস্থতায় ভুগছিলেন কবি অসীম সাহা৷ চিত্রটি গত ফেব্রুয়ারি মাসে তোলা৷ তখন তিনি ঢাকার বিএসএমএমইউ হাসপাতালে
লেখক জাকির হোসেনের পুত্র কবি ইরফান রহমান ঢাকার বিএসএমএমইউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কবি অসীম সাহাকে দেখতে যান

Latest