ঢাকা, জাকির হোসেন : "কেউ যদি আমাদের উৎখাত করে শান্তিতে থাকার চেষ্টা করে, তা হলে আমাদের বাংলাদেশটাও আফগানিস্তান কিংবা সিরিয়া হয়ে যাবে... যেখানে গণতান্ত্রিক শক্তি বলে কিছু থাকবে না, পুরোটাই সাম্প্রদায়িকতার অভয়ারণ্য হয়ে উঠবে"— গত শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের মহাসমাবেশের মঞ্চে দাঁড়িয়ে এভাবেই বলতে শোনা গিয়েছিল মঞ্চের মুখপাত্র ও সনাতনীদের অন্যতম মহাতীর্থ পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে। সাম্প্রতিক কালে গোটা বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের এত বড় সমাবেশ আগে কখনও হয়নি। ঠিক পরের দিন তিনি বলেছিলেন, ‘গত ৫৩ বছরে এ দেশে হিন্দুদের জন্য কেউ কোনও রক্ষাকবচ দেয়নি। যতবার সরকার বদল হয়েছে বাংলাদশে, ততবারই তার আগে-পরে টার্গেট হয়েছেন এ দেশের সংখ্যালঘুরা।’ সপ্তাহ ঘোরার আগে সেই চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারী সহ অন্তত ১৯ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা হলো রাষ্ট্রদোহের মামলা! অভিযুক্ত আরও কয়েকজন অজ্ঞাতনামা। অভিযোগ, গত ২৫ অক্টোবর লালদিঘি ময়দানে হওয়া সেই সনাতন মহাসমাবেশে এঁরাই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার উপরে অন্য একটি গেরুয়া রঙের পতাটা টাঙিয়ে দেশের মর্যাদাহানি করেছেন। ৩০ অক্টোবর রাতে কোতোয়ালি থানায় মামলাটি রুজু করেন চান্দগাঁও মোহরা এলাকার বাসিন্দা ফিরোজ খান নামের এক ব্যক্তি। পুলিশ সূত্রের খবর, ইতিমধ্যে ওই মামলায় রাজেশ চৌধুরী ও হৃদয় দাশ নামে দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলার কথা জানতে পেরেই মুখ খোলেন চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারী। ফেসবুকে এক ভিডিয়ো বার্তায় তিনি দাবি করেন, "আমাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা আদতে সনাতনীদের ৮ দফা দাবি আদায়ের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। ৫ আগস্ট সরকার বদলের পর থেকে সনাতনীদের উপর চলতে থাকা হামলা-নির্যাতনের প্রতিবাদেই আমাদের আন্দোলন। এই আন্দোলন কোনওভাবেই বর্তমান সরকার কিংবা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়। আমরা নিরাপদ সহাবস্থান নিশ্চিত করার দাবিতে আন্দোলন করছি। কোনও দলের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়।"তিনি বলেছেন, "আসলে লালদিঘির মাঠে সেদিন লক্ষাধিক মানুষের জমায়েত দেখেই ভয় পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ওই সমাবেশ থেকেই দাবি আদায়ে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের ডাকও দেওয়া হয়। সরকার তাতে আরও ভয় পেয়েছে। না হলে যে জায়গায় পতাকা টাঙানোর কথা বলা হচ্ছে, সেটা সভাস্থল থেকে অন্তত এক কিলোমিটার দূরে। এর সঙ্গে সমাবেশ আয়োজকদের ন্যূনতম সম্পর্কও থাকার কথা নয়।" চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারী সহ হিন্দু নেতাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের ও জোড়া হিন্দু গ্রেপ্তারির প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) চট্টগ্রামের চেরাগি পাহাড় চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল করেন স্থানীয় সংখ্যালঘুরা। মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে শুক্রবার বিকেলেও একই জায়গাতে বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে৷ সমাবেশ হয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলাতেও। সনাতন জাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস মহারাজ বলেন, “লালদীঘি মাঠে লাখো মানুষের জনসমুদ্র দেখে ভীত হয়ে সনাতনীদের দাবিয়ে রাখতে ‘মিথ্যা’ মামলা দেওয়া হয়েছে। আট দফা দাবিতে আমরা সনাতন জাগরণ মঞ্চ বিভাগীয় সমাবেশ অব্যাহত রাখবো।” স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস মহারাজ মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বলেন, “আমরা প্রশাসনকে সোমবার অবধি ৭২ ঘণ্টা সময় দিয়েছি মামলা প্রত্যাহারের জন্য। এর মধ্যে মামলা প্রত্যাহার না করলে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে৷" পুলিশ সূত্রের খবর, রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ হিসেবে আরও ১৫-২০ জনকে আসামি করা হয়। চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারীর মতো ইসকন শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষ লীলারাজ দাশ ব্রহ্মচারীর নামও রয়েছে আসামির তালিকায়।মামলাকারীর দাবি, গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের দিনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা চট্টগ্রামের নিউ মার্কেট চত্বরের জিরো পয়েন্টে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের উপর একটি লাঠিতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বেঁধে দেন। এর উপরই ২৫ অক্টোবর গেরুয়া রঙের অন্য পতাকা টাঙানোর অভিযোগ উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি ভাইরাল হতেই বিতর্ক ছড়ায় এবং শেষমেশ গেরুয়া পতাকাটি সরিয়েও নেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নানা ধরনের সমালোচনা হয়। পরে গেরুয়া পতাকাটি সেখান থেকে সরিয়েও ফেলা হয়। মামলাকারীর দাবি, জাতীয় পতাকার এই অবমাননা আদতে দেশের ‘অখণ্ডতাকে অস্বীকার করার শামিল’৷ একইসঙ্গে তাঁর দাবি, ‘জাতীয় পতাকার উপরে ধর্মীয় পাতাকা উত্তোলন করে আসামিরা দেশের ভিতরে অরাজকতা তৈরির মতো রাষ্ট্রদোহে লিপ্ত।’ এদিকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী সহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়েরের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও ঢাকা মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি। বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর ও সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা এবং মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব ও সাধারণ সম্পাদক ড. তাপস চন্দ্র পাল এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, অধিকার আদায়ের আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠার কারণে এ ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত মামলা করা হয়েছে, যা সারাদেশে ধর্মীয় ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এমনকি মামলা দায়েরের আগেই দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা বলেন, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি মনে করে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার যখন গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈষম্যহীন দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে যাচ্ছেন, তখন সংখ্যালঘুদের নিশানা করে এই ধরনের বিদ্বেষমূলক পদক্ষেপ সরকারের যাত্রাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবং ভুল বোঝাবুঝি বাড়াবে। তাই অবিলম্বে এই ভিত্তিহীন মামলা প্রত্যাহার এবং আটকদের মুক্তি দিয়ে সম্প্রীতির পরিবেশ বিকশিত করার আহবান জানিয়েছেন তারা।