ঢাকা, জাকির হোসেন: প্রায় ১৬ বছর বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বাংলাদেশের ইতিহাসের নৃশংস স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা তুমুল গণআন্দোলনের মধ্যে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালালো৷ মুক্তি পেলো বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ৷ বাংলাদেশজুড়ে মানুষের উল্লাস আর আনন্দ যেনো বাঁধ ভেঙেছে৷ একটা খুনীর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে দেশজুড়ে আনন্দের বন্যা বইছে৷ রাষ্ট্রীয় তথা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ৩৬ দিন আগে শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তরিত হওয়ার পর দেশজুড়ে সংঘাত আর সাড়ে আট হাজার মানুষের মৃত্যু ও ২৫ হাজার মানুষের গুলিবিদ্ধ ও বিভিন্নভাবে আহত হবার মধ্যে স্বৈরাচারী হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে হল। শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে করে দেশ থেকে পালালো। তার সঙ্গে তার বোন শেখ রেহানাও রয়েছে৷ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে সন্ধ্যায় দিল্লি লাগোয়া উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদের হিন্ডন এয়ারবেসে নামে হাসিনাকে বহনকারী সামরিক বিমান৷ খুনী হাসিনা শিগগিরই লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন বলে সূত্রের খবর। হাসিনা যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন বলেও খবর আসছে৷ এদিকে সর্বাত্মক অসহযোগের মধ্যে ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া জনতা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনও দখল করে নিয়েছেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদও দখলে নিয়েছেন গণমানুষ৷ সেখানে তাদের উন্মুত্ত উল্লাসের দৃশ্য মনে করিয়ে দিয়েছে ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ দখল করে জনতার উল্লাসের স্মৃতি৷ আর ঢাকার পথে পথে জনতার উচ্ছ্বাস আর সেনা সদস্যদের সঙ্গে তাদের হাত মেলানোর দৃশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার বিজয়ের দিনটিকে৷ একাত্তরের পর এটা বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা ও বিজয় বলে আখ্যা দিয়েছে বাংলার গণমানুষ৷
শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্রটি হাই কোর্ট বাতিল করার প্রতিক্রিয়ায়। ১ জুলাই মাঠে নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের টানা কর্মসূচির মধ্যে সরকারও হাই কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে, ফলে সেই আদেশ স্থগিত হয়ে যায়। পরিস্থিতি পাল্টে যায় ১৪ জুলাই। সেদিন চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা স্বৈরাচার হাসিনা বলে, “মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না তো কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?” পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বের হয় ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার, রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার, স্বৈরাচার৷' সেই রাতেই খুনী দল ওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ও বিশ্বে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পাওয়া 'ছাত্রলীগ' মিছিল বের করে, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি।’ পরদিন সকালে আওয়ামী লীগের আরেক নেতা ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের (যিনি কাউয়া কাদের নামে নেটিজেনদের মাঝে পরিচিত) এক বক্তব্যে বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঔদ্ধত্বের জবাব দেবে ছাত্রলীগ।" এর ম্লধ্যে দিয়ে কাদের সন্ত্রাসী ছাত্রলীগকে আরো উসকে দেন৷ সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা করে দেশীয় অস্ত্র ও পিস্তল নিয়ে। এর প্রতিবাদে পরদিন ১৬ জুলাই সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়৷ সেদিন সংঘর্ষে চট্টগ্রামের মুরাদপুরে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের নেতাসহ তিন জন, ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে এবং রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলিতে আবু সাইদ নামের এক শিক্ষার্থীর শহীদ হওয়ায় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়। কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির ডাক আসে শিক্ষার্থীদের তরফে। সেদিন ঢাকার বাড্ডা ও উত্তরায় সংঘাতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এরপরের কয়েকদিন দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের মদতপুষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা পুলিশ, র্যাব ও সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের হামলা ও নির্বিচারে গুলিবর্ষণে দেশজুড়ে গত ৪ আগস্ট অবধি আট হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়৷ গুলি ও বিভিন্নভাবে হামলায় দেশজুড়ে আহত হন ২২ হাজারের বেশি মানুষ৷ মৃত্যুর সংখ্যা ধামাচাপা দিতে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার সব হাসপাতাল থেকে রেজিস্ট্রার খাতা সরিয়ে ফেলে৷ হাসিনা সরকারের মন্ত্রীরা গণমানুষের বিপক্ষে গিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করতে থাকে৷ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কখনো ৮ দফা, কখনো ৯ দফা দাবি জানানো হয়। ঘটনার পরম্পরায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমাবেশ থেকে সরকার পতনের ‘এক দফা’ দাবি জানানো হয়। ওইদিন সন্ধ্যা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরফে ৫ আগস্ট সোমবার ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়৷ এদিন বেলা ১১টার পর থেকে লাখো লাখো ছাত্র-জনতা ঢাকার শাহবাগসহ বিভিন্ন অংশে প্রবেশ করতে শুরু করে। এরইমধ্যে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান জানান, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছে৷ এরপরই পুরো বাংলাদেশ উল্লাসে ফেটে পড়ে৷ মুহূর্তের মধ্যে দেশের সব মিষ্টির দোকান খালি হয়ে যায়৷ মানুষের উল্লাস আজ বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে মৃত্তিকায় ধ্বনিত হচ্ছে, এ উল্লাস স্বাধীনতার, এ উল্লাস বিজয়ের, এ উল্লাস বাংলাদেশ ও পুরো বিশ্বের ইতিহাসে এক নৃশংস স্বৈরশাসক হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তি পাওয়ার৷
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারি হয় বাংলাদেশে৷ প্রায় দুই বছর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদের সাথে যোগসাজশে অনেকটাই লোকদেখানো জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয় হাসিনা। এরপর টানা সাড়ে ১৫ বছর দেশ শাসন করে হাসিনা৷ স্বৈরাচারের এক রাজত্ব কায়েম করে বাংলাদেশের গণমানুষকে স্বাধীন দেশে পরাধীন করে রাখে হাসিনা ও তার সরকার৷ এরপরের তিনটি নির্বাচনেই বাংলাদেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি৷ একতরফাভাবে জুলুম করে লোকদেখানো নির্বাচনেই হাসিনা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়৷ এই তিন নির্বাচনে নানা বিতর্কের মধ্যেও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল হাসিনা। এবার গণআন্দোলনের মধ্যে তাকে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালাতে হলো৷ এই ১৬ বছরের শাসনে লাখ লাখ সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা, বিরোধীমতের মানু্ষের ওপর গুম, খুন, গণহত্যা চালায় হাসিনা সরকার৷ অবশেষে ২০২৪ সালে এসে বাংলাদেশের গণমানুষের আন্দোলনে পদত্যাগ করে দেশ পালাতে বাধ্য হয় ইতিহাসের নৃশংসতম এই স্বৈরশাসক৷
হাসিনার পতনের পর ও যে রাষ্ট্রীয় ভবনে থাকতো, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সেই রাষ্ট্রীয় ভবন 'গণভবন' দখলে নেয় গণমানুষ৷ সেখানে এক কোণে ৫ আগস্ট সন্ধ্যার দিকে উৎকট গন্ধ আসতে শুরু করে৷ গত ১ জুলাই থেকে চলা আন্দোলনে বহু মানুষের মৃত্যুকে ধামাচাপা দিতে গণহারে গণকবর দেওয়া হয়েছিলো নিহত মানুষগুলোকে৷ ধারণা করা হচ্ছে পিশাচ হাসিনা সরকার এতো মৃত্যুকে ধামাচাপা দিতে গণভবনেই গণকবরের রচনা করেছিল৷ এখন সেখানে মাটি খোঁড়া অব্যাহত রয়েছে৷ এদিকে, দেশ পরিচালনার জন্য একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠন করা হবে৷ ৫ আগস্ট সোমবার বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটের দিকে জনগণের উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে বানাদেশের সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান এ ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ দেশের বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে এ ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। তিনি বলেন, আমি জনগণের জানমালের দায়িত্ব নিয়েছি। আপনারা আশাহত হবেন না। আপনাদের সব দাবি পূরণ করা হবে৷ সেনাবাহিনীর প্রতি আশা রাখার আহ্বান জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, আপনারা আমাদের সহযোগিতা করেন। চলমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যত হত্যাকাণ্ড হয়েছে, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে। প্রতিটি অন্যায়ের বিচার হবে।